চট্টগ্রামে আদালত বন্ধে কষ্টে পড়ে গেছেন আইনজীবীরাও, শহর ছাড়লেন অনেকেই

করোনা পরিস্থিতিতে তিন মাস ধরেই আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে। এভাবে টানা তিন মাস অনেকটা কর্মহীন হয়ে পড়ায় আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেক আইনজীবী। আর্থিক দুরবস্থার মুখে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে ইতিমধ্যে গ্রামে চলে গেছেন অন্তত শতাধিক আইনজীবী। অন্যদিকে অনেকেই আবার অনিশ্চয়তার মুখে পেশা পরিবর্তন করার কথাও ভাবছেন। তারা বলছেন শুধু আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যাই নয় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ মানে আইনের আশ্রয়ের পথ বন্ধ হওয়া। মানুষ জমির দখল হারাচ্ছে, কিন্তু মামলা করতে পারছে না। নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অথচ মামলা করতে পারছে না। এভাবে সমাজে ভায়োলেন্স বাড়ছে, অথচ প্রতিকারের পথটা বন্ধ।

চট্টগ্রামে দেখা গেছে, প্রবীণ আইনজীবীদের চেয়েও অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে গেছে বিশেষ করে নবীন ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। এদের অনেকে গত ৪-৫ বছরের মধ্যে পেশায় এসেছেন। পেশায় নতুন আসায় তাদের কোনো সঞ্চয় নেই। এছাড়া দৈনিক আদালতে থাকা ও দৈনিক মামলার ভিত্তিতেই যেহেতু আয় হয়, ফলে দিনের খরচ দিনে মেটাতে গিয়ে সঞ্চয় করার অবস্থাও ছিল না তাদের। ফলে করোনা পরিস্থিতিতে তাদের অনেকেই পড়ে গেছেন ধারকর্জের জালে। টানা তিনমাস বন্ধে সেই ধারকর্জ দিন দিন কেবল বেড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইনজীবী নিজের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বললেন, ‘করোনার সময় থেকে গ্রামে চলে এসেছি। বাসা ভাড়ার কথা বাদই দিন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও কিভাবে কিনবো? আমরা যারা দৈনিক আয়ের মানুষ, তাদের জন্য শহরে থাকার খরচটাও কুলানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষত গত কয়েকবছরের মধ্যে যারা আইনজীবী তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদের তেমন কোন সঞ্চয়ও নেই। এ কারণেই বলতে পারেন হাজারখানেক আইনজীবী হয়ত ভালো আছেন। কিন্তু বেশিরভাগ আইনজীবীরা দুর্দশায় রয়েছে। আমার নিজের অবস্থা ভাল না তবুও আমি কয়েকজনকে সাহায্য করেছি। এভাবে আর কতদিন!’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষানবিশ আইনজীবী বলেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, এই পেশার চেয়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আর কী আছে সরকারের জন্য বা একটা স্বাধীন দেশের জন্য? অথচ এই পেশার পেশাজীবীরা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। একজন ডাক্তার ইন্টার্নি করার সময়ও বেতন পায়। আর ইঞ্জিনিয়াররা ইন্টার্নি করার সময়ও সম্মানী পায়। আমরা পাই না। অনেকবারই পেশা ছাড়ার কথাই ভেবেছি। কিন্তু এ পেশায় মহৎ একটা কজ (কারণ) আছে। যাব বলেই চলে যেতে পারি না। এভাবে হলে সামনে আর মেধাবীরা এই পেশায় আসবে না। একসময় দেখবেন এই পেশায় ব্যারিস্টার রফিকুল হক স্যার, ড. কামাল হোসেন স্যার, খন্দকার মাহবুব হোসেন স্যার, বর্তমান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্যারের মতো বিজ্ঞ আইনজীবী আর আসবে না, পাবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একদম সত্যি কথা হলো নবীন আইনজীবীদের মধ্যে ৮০% খুবই অসহায় অবস্থায় আছে। এরকম হলে সামনে ৮-১০ বছর পরে দেখা যাবে প্রকৃত মেধাবীরা এই পেশায় কখনও আসবে না আর।’

আইনজীবীদের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরে অ্যাডভোকেট সাইফুন্নাহার খুশি বলেন, ‘আমাদের আয় দৈনিক। অনেকেই আছে দিন শেষে আয় করে সে টাকা থেকেই বাসায় বাজার করে নিয়ে যান। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেকজনকে চিনি, যাদের বাসার বাজার করতেও সমস্যা হচ্ছে। একেবারেই করুণ অবস্থা। এপ্রিলে ১০০ জন আইনজীবীকে ১০ হাজার টাকা করে ঋণ দিয়েছে আইনজীবী সমিতি। কিন্তু তা দিয়ে কয়দিন চলে বলুন? আমার জানামতে, চট্টগ্রাম শহর ছেড়েছেন শতাধিক আইনজীবী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নগরের বাসাও ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ এমনকি পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছেন।’

তিন মাস ধরে নিয়মিত আদালত বন্ধ থাকায় প্রাকটিসিং লইয়ারদের অবস্থা মানবেতর রূপ নিয়েছে— এমনটি জানিয়ে অ্যাডভোকেট জিকো বড়ুয়া বলেন, ‘অনেকে পরিবার-পরিজনের চিন্তায় নগর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি পেশা পরিবর্তনের কথাও ভাবছেন। তাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত আদালত চালু করে দিয়ে এবং ভার্চুয়াল আদালত কার্যক্রমের সংশোধিত নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি মনে করছি।’

চট্টগ্রামে বেশিরভাগ আইনজীবীই আর্থিক কষ্টে আছেন উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট শামীমা ফেরদৌস মিলি বলেন, ‘আমরা আইনজীবীরা সাধারণত প্রতিদিনই আয় করি। কেউ কম কেউ বেশি। মাসের শেষে চাকরিজীবীদের মত নির্দিষ্ট কোন বেতন নেই আমাদের। আর পেশাটা হচ্ছে গুরুবিদ্যা পেশা। যার কারণে কোর্ট বন্ধ থাকা মানে আমাদের আয় বন্ধ। খুব কম আইনজীবীই আছেন যারা মাসের পর মাস বসে জমানো টাকায় সংসার চালাতে পারেন।’

অ্যাডভোকেট জুবাইদা সরওয়ার নিপা বললেন, ‘সিনিয়র হোক বা জুনিয়র সবাই আয় করে কিন্তু দৈনিক ভিত্তিতেই। এখন দীর্ঘদিন যদি পেশা বন্ধ থাকে আইনজীবীরা আয়ের পথটা তো বন্ধ। এখন আইনজীবীর সাথে সাথে তার ওপর নির্ভরশীল জুনিয়র অ্যাসোসিয়েটরা আয় করতে পারছে না। অর্থনৈতিক কষ্টে পড়া তো স্বাভাবিক। মামলা ফাইলিং না হওয়ায় সমাজেও এর একটা প্রভাব পড়বে। শুধু জামিন শুনানি দিয়ে কোর্ট চলছে বলা যায় না।’

এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী এএম জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘আামাদের পেশাটা ব্যবসা নয়, মহৎপেশা। অর্থের চেয়ে মানুষের আইন অধিকার লংঘনের বিষয়টিই বেশি গুরুত্ববহ। কাজ করলে আামাদের আয় হয়, নইলে নয়। মানুষের অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত পেশাজীবী মানেই আইনজীবী। তারা আজ নিজেরাই আর্থিক সংকটে। যাদের মাসিক বেতন নিশ্চিত, তারা বিষয়টি অনুভব করতে পারে না, করতে চায়ও না।’

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!