রাজীব সেন প্রিন্স :
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ডাই অ্যামোনিয়া ফসফেট (ডিএপি) সার কারখানার ট্যাংক বিস্ফোরণের কারণ খতিয়ে দেখতে রোববার সকাল সাড়ে আটটায় চায়না কমপ্ল্যান্টের ভাইস প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের চীনা প্রতিনিধি দল এসে পৌছায় কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড়ে দুর্ঘটনাকবলিত ডিএপি প্ল্যান্টে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যোগ দেন বিসিআইসির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ডিএপিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল কান্তি বড়ুয়া, ডিএপিএফসিএলের ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মোফাজ্জল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান প্রধান কর্মকর্তারা। তবে এসময় উপস্থিত ছিলনা কোন তদন্ত টিম।
ডিএপি সূত্র জানায়, ট্যাংকের মেয়াদকাল ২৫ বছর হলেও এগার বছরের মাথায় তা বিস্ফোরিত হওয়ায় অস্বস্থিতে আছে চীনা কর্তৃপক্ষ। বিস্ফোরণের নেপথ্যে নির্মাণগত ত্রুটি নাকি পরিচালনগত ত্রুটি সেটা নিশ্চিত করতে চীনা প্রতিনিধি দলের এ সফর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০১ সালে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিএপি কারখানা নির্মাণ করে চায়না কমপ্লেন্ট কোম্পানি। এ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ছিলেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান। ২০০৬ সালে এ কারখানা উৎপাদনে যায়। কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডাই অ্যামোনিয়া ফসফেট সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণেই এই কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল আনোয়ারার রাঙাদিয়ায়।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ডায় অ্যামোনিয়া ফসফেট ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএপিএফসিএল) বিস্ফোরিত অ্যামোনিয়া ট্যাংক ও ডিএপি প্ল্যান্টটি দৈনিক ৮০০ টন সার উৎপাদন করার কথা থাকলেও এটি ৩০০-৪০০ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারে না।
ঘুরে ফিরেই আসছে নির্মাণ ত্রুটি, তদারকির অভাব, তাগাদা দেয়ার পরও ওভারহোলিং বা বিএমআরআই না করা, সর্বোপরি মেনটেনেন্স ইউনিটের উদাসীনতার কারণেই এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। অ্যামোনিয়া গ্যাসের এ ট্যাংক বিস্ফোরণে আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়া, গোবাদিয়া, পারকিসহ আশপাশের এলাকার পরিবেশ ও মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএপির এক কর্মকর্তা জানান, অ্যামোনিয়া ট্যাংকের বাইরে ডিএপির আরো সাতটি ফসফটিক ট্যাংক রয়েছে। যেগুলোর প্রত্যেকটির ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টন। এসব ট্যাংকের মনিটরিং কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন তা নষ্ট ছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিসিআইসির পরিচালনায় কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে প্রতিষ্ঠা করা হয় ডিএপি কারখানা। এখানে দুই ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১৬শ’ মেট্রিক টন।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে কখনোই কারখানাটি পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে না পারলেও দুই ইউনিট থেকে বছরে দেড় লাখ টন উৎপাদন হয়ে আসছিল। গত ২২ আগষ্ট সোমবার রাতে বিস্ফোরণে একটি ট্যাংক পুরোপুরি বিধ্বস্থ হয়। ডিএপি-১ প্ল্যান্টের ৫০০ টন ধারণক্ষমতার একটি অ্যামোনিয়া রিজার্ভ ট্যাংক বিস্ফোরত হয়ে ৫০ ফুট দূরে উড়ে পড়ে। এটি মেরামতযোগ্য নয়। তাছাড়া কারখানাটি ‘টুইন’ হিসাবে নির্মিত হওয়ায় একটি ইউনিট আলাদা করে উৎপাদনেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না । ফলে উৎপাদন খাতে ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কারখানার বর্তমান যে অবস্থা তাতে নতুন ট্যাক তৈরি ও নির্মাণ ত্রুটি সারানোর পর উৎপাদনে যেতে ছয় থেকে এক বছর সময় লেগে যাবে। এই হিসাবে শুধু এক বছর কারখানা বন্ধ থাকলে উৎপাদনে ক্ষতি হবে সাড়ে চারশ’ কোটি টাকা। বিস্ফোরিত ট্রাংকে থাকা আড়াইশ’ টন অ্যামোনিয়ার দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। ডিএপি প্রকল্পে ব্যবহৃত এই অ্যামোনিয়া পার্শ্ববর্তী কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) থেকে কেনা হতো। কাফকো থেকে দৈনিক ২৫০ মেট্রিক টন এ্যামোনিয়া নিত ডিএপি। ট্যাংক পুন:স্থাপনে করতে কত টাকা লাগবে সেটা চ’ড়ান্ত করতে আসছে চীনা বিশেষজ্ঞ দল। তাতেও লাগতে পারে অর্ধশত কোটি টাকা।
এদিকে বিস্ফোরণের পর অ্যামোনিয়া গ্যাসের বিষক্রিয়ায় অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই গ্যাস বাতাসের ধাক্কায় কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কাঠগড়, ইপিজেড, হালিশহর এলাকায় চলে আসে এবং মানুষ শ্বাসকষ্টে ভোগেন। এ সময় আতঙ্কের শহরে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। বিস্ফোরণের পরদিন ডিএপি কারখানার আশপাশের বেশ কিছু মাছচাষের ঘেরে প্রচুর মাছ মারা যায়। মাছচাষিদের দাবি, কয়েক কোটি টাকার মাছ মারা গেছে। গবাদিপশুসহ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পরিবেশ দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী অ্যামোনিয়া দুর্ঘটনার পর কারখানার পাশের দুটি খামারের পানি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডিও, পিএইচ ও সিওডির মাত্রা ১৯৯৭ সালের পরিবেশ আইন অনুযায়ী বিপদজ্জনক মাত্রায় পাওয়া গেছে। ডিওর মাত্রা ছিলো ১.৩৯ থেকে ৪.০০ পর্যন্ত যদিও মানসম্মত মাত্রা হচ্ছে ৪.৫ থেকে ৮.৫। পিএইচ এর মাত্রা পাওয়া গেছে, ৯.৯৪ এবং ৮.৫৪ (আদর্শ মান ৬.৫ হতে ৮.৫) সিওডির মাত্রা পাওয়া গেছে, যথাক্রমে ৩২৪, ২৬৪ অথচ আদর্শ মান হচ্ছে ২০০ এর কম।
দূর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুর রশিদকে আহ্বায়ক এবং আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গৌতম বাড়ৈ ও কর্ণফুলী থানার ওসি রফিকুল ইসলামকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শন টিম দুর্ঘটনাকবলিত স্থান পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে কমিটির সদস্যরা কারখানার উৎপাদন ও পরিচালন সংশ্লিষ্ট সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এখন পর্যন্ত ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত না হলেও ট্যাংক সংস্কার, উৎপাদন ক্ষতি, পরিবেশ-মৎস্য খাত মিলিয়ে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশংকা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন এরই মধ্যে বিস্ফোরিত ট্যাংকের কিছু উপাদান বুয়েটে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নির্মাণ ত্রুটি থাকলে বুয়েটের পরীক্ষায়ও তা ধরা পড়বে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তারা বলেন, আনোয়ারায় কারখানার আশপাশের এলাকার পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পানি ও বাতাসে অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রাও সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। তবে জলাশয়ে ভেসে ওঠা মরা মাছের গন্ধে পরিবেশ এখনও ভারি। এসব মরা মাছ খামারিদের পুঁতে ফেলার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল উপজেলা মৎস্য অফিস। কিন্তু খামারিরা তা করেনি।
২৪ আগস্ট বিকেলে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।
রিপোর্ট : রাজীব সেন প্রিন্স
এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::