চট্টগ্রামে অবৈধ অটোরিকশা ঘিরে মাসে কোটি টাকার ‘টোকেন’ চাঁদাবাজি

এক বাকলিয়াতেই চলে তিন হাজারেরও বেশি ইজিবাইক

সারাদেশের অ্যাসিড ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার ইজিবাইক অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু নির্দেশনা না মেনে নগরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অবৈধ ইজিবাইক। আর এসব পরিবহনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় এক চাঁদাবাজচক্র। রুট পারমিটের নামে ভিন্ন কৌশলে চলছে টোকেন ব্যবসা। বিশেষ কৌশল হিসেবে রাখা হয়েছে প্রতিবন্ধীদেরও।

চট্টগ্রামে অবৈধ অটোরিকশা ঘিরে মাসে কোটি টাকার ‘টোকেন’ চাঁদাবাজি 1

নগরের চান্দগাঁও, লালখানবাজার, টাইগারপাস, ঝাউতলা, আমবাগান, ওয়্যারলেস মোড়, জালালাবাদ, খুলশী, বাকলিয়াসহ বিভিন্ন অলিগলি ও প্রধান সড়কে সরেজমিন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, লালখানবাজার এলাকায় ১৬০টি অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে মোট ২৪ হাজার টাকার টোকেন বাণিজ্য হয়। টাইগারপাস মোড়, ঝাউতলা, আমবাগান এলাকায় ৩০৫টি অটোরিক্সা থেকে ১৫০ টাকা করে ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা, ওয়ারলেস মোড় জালালাবাদ এলাকায় ১৮০টি অটোরিকশা থেকে ২৭ হাজার টাকা টোকেন ব্যণিজ্য হয়। আর বাকলিয়া হলো ইজিবাইকের স্বর্গরাজ্য। ওই এলাকায় রয়েছে তিন হাজারেরও বেশি ইজিবাইক।

গ্যারেজভিত্তিক এসব ইজিবাইক পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিবন্দ্বীদের। সপ্তাহখানেক আগে চকবাজার ধুনিরপুল এলাকায় হাতবিহীন এক প্রতিবন্ধী ইজিবাইক চালাতে গিয়ে রাস্তার পাশে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। তাদের বেপরোয়া চলাচলে স্থানীয়রা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। তাছাড়া এসব অটোরিকশার গ্যারেজে মিটারের পাশাপাশি রয়েছে অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ।

জানা গেছে, এসব অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের সহায়তায় চালানো হচ্ছে।

এছাড়া নগরের বাকলিয়ার ময়দার মিল, বউবাজার এলাকাসহ বিভিন্ন মোড়ে এসব ইজিবাইক থামিয়ে টাকা নেয় একটি চক্র। কারা টাকা নিচ্ছে বা কেন নিচ্ছে— এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে জানা যায়, সারাদেশের অ্যাসিড ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার ইজিবাইক অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। চলাচল, আমদানি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে এসব ইজিবাইকের। কিন্তু ‘চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশা মালিক সমিতি’ নামের এক প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টের নির্দেশনা ওপর তাদের বানানো এক আদেশে জানায়, মহাসড়কে নয় অলিগলিতে চলতে পারবে এসব ইজিবাইক। কিন্তু এ আদেশে হাইকোর্টের কোনো স্বাক্ষর বা সিলমোহর ছিল না।

জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি দিয়ে থাকে চিহ্নিত কিছু সংগঠন। এসব সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় নেতা-জনপ্রতিনিধিরা। এসব রিকশা চলাচলের জন্য থাকতে হবে বিশেষ এক স্টিকার বা টোকেন। আবার এসব সংগঠন থেকে মাসোহারা নিতে বাদ যান না কথিত সাংবাদিক থেকে শুরু করে কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যও।

টোকেন সম্পর্কে জানতে কথা হয় বেশ কিছু অটোরিকশা চালকের সঙ্গে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাকলিয়া এলাকার এক অটোরিকশা চালক বলেন, ‘নামে টোকেন হলেও মূলত পুলিশের টাকা বলে জানি। অটোরিকশা রাস্তায় চলাচলের জন্য প্রতিমাসে টোকেন নিতে হয়। টোকেন না থাকলে রাস্তায় রিকশা চলাচল করতে দেন না মহিবুল্লাহর ছেলেরা। মাসিক টোকেনের জন্য ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। তাছাড়া দৈনিক হিসেবে হলে ৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। তারা এসব টাকা থেকে একটি অংশ বাকলিয়া, চকবাজার ও কোতোয়ালী থানায় দেন। তাছাড়া বাকলিয়া টিভির সাংবাদিক আতিক, বি-প্লাস টিভির জোবাইরও টাকার ভাগ নেয়।’

কেন এ টোকেন কিনতে হয়— এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্য এক অটোরিকশা চালক বলেন, ‘মূলত পুলিশ না ধরার জন্য এসব টোকেন কিনতে হয়। টোকেন থাকলে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো পুলিশি ঝামেলা থাকে না। তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সার্জেন্ট গলির ভেতর এসে ধরে নিয়ে যায়। দাবিকৃত টাকা দিতে না পারলে টো করে দেয়। এতে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা দিয়ে অটোরিকশা ছাড়িয়ে আনতে হয়।’

কিন্তু কে এই মুহিবুল্লাহ? তার সম্পর্কে অনুসন্ধানে কথা হয় রাসেল নামের একজনের সঙ্গে। রাসেল মূলত মহিবুল্লাহর হয়ে কাজ করেন পুলিশ নিয়ন্ত্রণে। তিনি বাকলিয়া থানা শ্রমিক লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। পরিচয় গোপন রেখে টোকেন প্রয়োজন জানালে তিনি বলেন, ‘বউবাজার এলাকায় অটোরিকশার ধাক্কায় মাদ্রাসা ছাত্র নিহতের ঘটনায় লাইন বন্ধ আছে। তবে কিছুদিনের মধ্যে চালু হবে। সেই সময় যোগাযোগ করলে টোকেন পাওয়া যাবে।’

নগরের বিভিন্ন এলাকায় মহিবুল্লাহর হয়ে কাজ করেন অনেকে। তবে টোকেন দেওয়ার মালিক মুহিবুল্লাহ।

এদিকে ‘সাংবাদিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামক এক কথিত সংগঠনও এসব রিকশার কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অজুহাতে।

এ বিষয়ে জালালাবাদ এলাকার এক অটোরিকশা চালক জানান, গত রমজানে সাংবাদিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান ‘চট্টলার পাতা’র বাবলু নামের এক সাংবাদিক। এ সময় বাবলু বলেন, ‘স্যার একটি কার্ড দিয়ে যাবে। স্যার আসলে ৫ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েন। সেই সময় তাকে ১ হাজার টাকা দিয়ে ইফতার মাহফিলে আরও কিছু টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিই। এর মধ্যে ‘মিউজিক বাংলা টিভি’ স্টিকার লাগানো একটি গাড়িতে করে মিজান নামের এক ব্যক্তি একটি ইফতারের দাওয়াত কার্ড দিয়ে যান। এভাবে তারা প্রতি অটোরিকশা থেকে হাতিয়ে নেয় ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।’

এদিকে চান্দগাঁও এলাকায় বেলাল, লিটন, ইসমাইল ও মহিউদ্দিন নামের কিছু ব্যক্তি টোকেন বাণিজ্যে জড়িত। এতে কাপ্তাই রাস্তার মাথার সিডিএ স্কুল থেকে বাহির সিগন্যাল বোর্ড স্কুল পর্যন্ত চলে তাদের নৈরাজ্য। দৈনিক ২৫০টি অটোরিকশা থেকে ১৭০ টাকা করে সর্বমোট ৪২ হাজার ৫০০ টাকা টোকেনের নামে চাঁদা নেওয়া হয়। জানা যায়, এই এলাকা থেকে ডি এ দিদার, ইমন, হান্নান রহিমসহ অনেক সাংবাদিককে টাকা দিতে হয় প্রতি মাসে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মহিউদ্দিন বলেন, ‘সাংবাদিকদের প্রতি সপ্তাহে ৭৫০ টাকা করে দিতে হয়। টাকা না দিলে ট্রফিক টিআই ও পুলিশকে বলে অটোরিকশা টো করে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রতি সপ্তাহে টাকা দিতে হয়।’

টাইগারপাস ও ঝাউতলা আমবাগানের অটোরিকশা নিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে এক অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয়। এখানেও ওঠে আসে কথিত সেই সাংবাদিক উন্নয়ন সংস্থার নাম। অটোরিকশা চালক বলেন, ‘প্রতিটি অংশের টাকা সাপ্তাহিক মাসোহারা হিসেবে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন কিছু চাঁদাবাজ ও কথিত সাংবাদিক। এসব অটোরিকশা সুমনের নামে চলে। গত রমজানে সে ৫০ হাজার টাকা দারি করলে ২০ হাজার টাকা দিই। এসব এলাকায় এমবি মিউজিক টিভির মিজান, চট্টলার পাতার মোমেন, জামাল, শাকিল, বাবলু টাকা নেয়। বর্তমানে রমিজ ভান্ডারী ও শাহাবুদ্দিন নতুন করে আমবাগান ঝাউতলা সড়কে অটোরিকশা লাইন চালায়।’

চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচিত সানাউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘নগরসহ উত্তর ও দক্ষিণ জেলার মালিক সমিতি মিলে হাইকোর্টে রিট করেছিলাম। আপিল বিভাগ থেকে রায় পেয়েছি। রায়ে উল্লেখ আছে, মহাসড়কে অটোরিকশা চলতে পারবে না, তবে সড়কে চলতে পারবে। সাংবাদিকরা সবসময় আমাদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ লেখালেখি করেন। সেই জন্য সাংবাদিকদের পছন্দ করি না।’

হাইকোর্টের অটোরিকশার আপিলের বিষয় জানতে কথা হয় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কান্তি নাথের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আপিলের কপি আমরা দেখেছি, অটোরিকশা চলার অনুমতি দেয়নি। নম্বরবিহীন গাড়ি সড়ক ও মহাসড়কে চলাচল করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’

ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!