চট্টগ্রামের ৫ আইনজীবী ফেঁসে যেতে পারেন নিরপরাধ নারীকে জেল খাটানোর ঘটনায়

জেল-মৃত্যুতে তছনছ একটি পরিবার

সাজাপ্রাপ্ত আসামির বদলে নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেল খাটানোর ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন চট্টগ্রামের পাঁচ আইনজীবী। কিভাবে একজন হত্যামামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির বদলে নিরাপরাধ নারীকে জেল খাটানো হলো হাইকোর্ট— তার কারণ জানতে চেয়ে সাজাপ্রাপ্ত কুলসুমীর পাঁচ আইনজীবীকে নোটিশ দিয়েছে।

এই পাঁচ আইনজীবী হলেন জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এমএ নাসের, নুরুল আনোয়ার, বিবেকানন্দ চৌধুরী, পুষ্পেন্দু কানুনগো এবং সৌরভ। ইতোমধ্যে এই পাঁচজন আইনজীবী উচ্চ আদালতে একবার হাজিরাও দিয়েছেন। চলতি সপ্তাহে তাদের আরও একবার হাজিরা দেওয়ার কথা রয়েছে।

২০০৬ সালে নগরীর রহমতগঞ্জে মোবাইলে কথা বলার অপরাধে পোশাক শ্রমিক কোহিনুরকে গলা টিপে হত্যা করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখেন কুলসুমী। ২০১৭ সালে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে কুলসুমী আক্তারের যাবজ্জীবন সাজা হয়। সেই আদেশে ২০১৮ সালের ১২ জুন সাজা ভোগের জন্য কারাগারে যান ‘কুলসুমী’। প্রায় তিন বছর সাজা ভোগের পর জানা যায়, কুলসুমীর বদলে জেল খাটছেন নিরাপরাধ মিনু। আইনজীবীদের প্রচেষ্টায় জেল থেকে বের হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় রহস্যজনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় মিনুর। এরপর গায়েব হয়ে যায় মিনুর ছোট ছেলেও। গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নিরাপরাধ মিনুর জেল খাটার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিনুর সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন আমরা সকলকেই আইনের মুখোমুখি করতে চাই। ইতোমধ্যে কুলসুমীকে আইনি সহযোগিতা দেওয়া পাঁচজন আইনজীবীকে মহামান্য হাইকোর্ট কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।’

মিনুর কারাভোগের ব্যাপারে এই আইনজীবীদের হাত থাকতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মুরাদ বলেন, ‘এটা যেহেতু এখন আদালতে চলমান একটা বিষয়, তাই আমি এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। তবে আদালত তাদের কাছ থেকে প্রমাণ চেয়েছে, কিছুদিনের মধ্যে ওরা জড়িত কিনা তা প্রমাণ হয়ে যাবে।’

এ ব্যাপারে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু এটা চলমান আইনি প্রক্রিয়া। তাই এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে আদালত থেকে যদি আমাদের আদেশ দেওয়া হয় তবে আমরা অবশ্যই তাদের আটক করবো।’

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএইচএম জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘আইনজীবীদের কাজ অসহায় মানুষকে আইনি সহযোগিতা দিয়ে মক্কেলের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। তবে কোনো আইনজীবী যদি নিজের প্রফেশনকে কাজে লাগিয়ে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী বানিয়ে দেয় তবে সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি ও প্রফেশন পরিপন্থী কাজ।’

তিনি বলেন বলেন, ‘কুলসুমার বদলে মিনুকে জেল খাটানোর কাজটি কুলসুমার আইনজীবীরা জেনে-বুঝে করেছেন, নাকি ভুলবশত করেছেন আমি জানিনা। যদি জেনে-শুনে তারা এই কাজ করেন তবে আমিও চাই তাদের শাস্তি হোক।’

আইনজীবী নিজের তার মক্কেলকে চিনবেন না বা আইনজীবীর সহযোগিতা ছাড়া এমন কাজ সম্ভব কি-না এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান এই আইনজীবী নেতা।

তবে তিনি বলেন, ‘এই পাঁচ আইনজীবী যদি দোষী হয় আদালতের নির্দেশে আমাদের বার কাউন্সিল পদক্ষেপ নেবে। আমরা জেলা আইনজীবী সমিতি থেকেও তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবো।’

২০০৬ সালে নগরীর রহমতগঞ্জে মোবাইলে কথা বলার অপরাধে পোশাক শ্রমিক কোহিনুরকে গলা টিপে হত্যা করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখেন কুলসুমী। কুলসুমী এই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও ময়নাতদন্তে বোঝা যায় ঘটনাটি পুরোপুরি হত্যা। দুই বছর তদন্তের পর পুলিশ আদালতে এই মামলার চার্জশিট জমা দেয়।

২০১৭ সালে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে কুলসুমী আক্তারের যাবজ্জীবন সাজা হয়। ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম। সেই আদেশে ২০১৮ সালের ১২ জুন সাজা ভোগের জন্য কারাগারে যান কুলসুমী। প্রায় তিন বছর সাজা ভোগের পর জানা যায়, কুলসুমীর বদলে জেল খাটছেন নিরাপরাধ মিনু।

চট্টগ্রামের আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ বিষয়টি সর্বপ্রথম বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে।

এরপর গত ২২ মার্চ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁইয়ার আদালতে মিনুকে হাজির করা হলে আদালত তাকে জামিন দিয়ে মুল আসামী কুলসুমীকে আটকের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কুলসুমী ও তাকে সহযোগিতা করার অপরাধে মর্জিনা আক্তার নামে আরও এক নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এদিকে জেল থেকে বের হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় রহস্যজনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় মিনুর। এরপর গায়েব হয়ে যায় মিনুর ছোট ছেলেও। পরে সাজাপ্রাপ্ত কুলসুমী ও মর্জিনাকে রিমান্ডে নেওয়ার পর এ ঘটনায় বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য।

জানা যায়, মাত্র দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে নিরাপরাধ মিনুকে যাবজ্জীবন সাজা ভোগে প্ররোচিত করা হয়। আর এই পূর্বপরিকল্পিত কাজে সহযোগিতা করে ছিন্নমুল এলাকার দুই নেতা নুর আলম কাওয়াল (৪৮) এবং মো. শাহাদাত হোসেন (৪২)। তাদেরও কোতোয়ালী থানা পুলিশ গ্রেফতার করে।

মূলত ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর হত্যামামলায় কুলসুমীর যাবজ্জীবন সাজার আদেশ দিলে আঁকা হয় এই পরিকল্পনার ছক। সাজা থেকে বাঁচতে কুলসুমী মিনুকে দেড় লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেয়। বিনিময়ে মিনুকে কুলসুমী সেজে কারাভোগ করতে হবে। তবে এক মাস পরেই মিনুকে জামিনে বের করিয়ে আনবে কুলসুমী— এমন শর্তও দেওয়া হয়। আর এই পরিকল্পনায় কুলসুমীকে সাহায্য করে ছিন্নমূল এলাকার সমাজ নেতা নুর আলম ও শাহাদাত।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালে মিনুকে কুলসুমী সাজিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। মিনু নিজেকে কুলসুমী পরিচয় দিয়ে সাজা ভোগ করতে জেলে যায়। এক মাসের কথা থাকলেও মিনুকে থাকতে হয় প্রায় তিন বছর।

বিনা দোষে কারাবাসের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত ১৬ জুন মুক্ত হন মিনু আক্তার। মুক্ত হওয়ার কয়েক দিন পর ২৮ জুন দিবাগত রাতে বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মিনু।

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!