চট্টগ্রামের ৩ থানায় ‘ক্যাশিয়ার’ অলির চাঁদাবাজির জাল, চকবাজারেই মাসে ২ লাখ

তিনি রাজনৈতিক কোনো নেতা নন, সরকারি উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তাও নন। তবুও চট্টগ্রাম নগরীতে চলেন দাপটের সঙ্গে। তার ইশারায় নাকি সিএমপির বেশ কিছু থানার পুলিশ ওঠাবসা করে৷ গত এক দশকে গড়েছেন টাকার পাহাড়, চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জিততে পারেননি।

বলছিলাম চট্টগ্রাম নগরীতে ভাগ্যের সন্ধানে আসা নোয়াখালীর মো. অলিউদ্দিন হাওলাদারের কথা। চট্টগ্রামে পা দিয়েই তিনি যেন পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে যান নগরীর চকবাজার থানার ‘ক্যাশিয়ার’। এর বাইরেও তাকে বিভিন্ন থানার ‘মেস ম্যানেজার’ হিসেবেও চেনেন অনেকে। তার এসব পদবির কোনোটিই বৈধ নয়। তার চাঁদাবাজি চকবাজার থানার গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আকবরশাহ ও ডবলমুরিং থানা এলাকায়ও। ‘চট্টগ্রাম হালকা মোটরযান চালক শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামের এক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দেন তিনি।

চট্টগ্রামের ৩ থানায় ‘ক্যাশিয়ার’ অলির চাঁদাবাজির জাল, চকবাজারেই মাসে ২ লাখ 1

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে আসার পর অলি প্রথমে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে হয়ে ওঠেন চকবাজার, আকবরশাহ ও ডবলমুরিং থানার ‘ক্যাশিয়ার’। যদিও পুলিশ বাহিনীতে ক্যাশিয়ার পদ বলতে কিছু নেই৷ তবে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের নীরব সমর্থন থাকায় চাঁদা আদায়ে বেগ পেতে হয় না অলিকে। একসময় নিজেই মোটরসাইকেলে ঘুরে ঘুরে টাকা তুলতেন। কিন্তু বর্তমানে বেতনভুক্ত কর্মচারী দিয়ে টাকা তোলেন অলি।

চকবাজার থানা এলাকায় ক্যাশিয়ার অলি নিয়ন্ত্রণ করেন ধুনীরপুল থেকে ফুলতলা, কেবি আমান আলী রোড, ডিসি রোড, লালচাঁন্দ রোড, তেলিপট্টি রোড, কাপাসগোলা, গুলজার মোড, কলেজ রোড ও প্যারেড কর্ণার এলাকা। এসব এলাকা থেকে বিভিন্ন ধাপে দৈনিক প্রায় ৬ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। মাস শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া জুয়ার বোর্ড ও আলো-আঁধারি রেস্টুরেন্ট থেকেও প্রতিমাসে মোটা অংকের চাঁদা নেন অলিবাহিনী। নানামুখি চাপে বেশ কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও সম্প্রতি চকবাজার থানায় নতুন ওসি আসার পর ফের দৌরাত্ম্য বেড়েছে অলির৷

অলির অন্যতম সহযোগীরা হলেন চকবাজার থানার এলাকার রাহাত্তারপুলের মো. সোহেল, ডিসি রোডের রাসেল, বড়মিয়া মসজিদ এলাকার বিপ্লব, মামুন, গুলজার এলাকার ল্যাডা নাছির ও সেকান্দার। এদের মধ্যে চকবাজার থানার নাম দিয়ে সোহেল ও নাছির, ফাঁড়ির জন্য বিপ্লব এবং টহল পুলিশের জন্য টাকা তোলেন রাসেল। এছাড়া প্যারেড কর্ণার, কলেজ রোড, গুলজার, অলি খাঁ মসজিদ কাপাসগোলা এলাকায় অলির নামে চাঁদা উঠায় আলী ও রবি। প্যারেড কর্নার এলাকায় আলী ভ্যানগাড়িতে চা বিক্রি করে। আর রবি সন্ধ্যায় একই এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করে। এসব টাকা এসে জমা পড়ে মামুনের হাতে। মামুন পরে বুঝিয়ে দেন অলিকে।

প্রতিমাসে আদায় করা এসব অর্থের একটি বড় অংশ সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থেকে অন্যান্য কর্মকর্তাদের পকেটে যায়। ফলে এসব স্পটগুলোতে পুলিশের অভিযান নেই বললেই চলে। তবে মাঝেমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা আসলে লোক দেখানো অভিযান চালানো হয় বলে জানান স্থানীয়রা।

আরও জানা গেছে, বিদায়ী ওসির তৎপরতায় যেসব বেআইনি কারবার বন্ধ হয়েছিল, তা পুনরায় চলছে অলির যোগসাজশে। মাদকে ভাসছে চকবাজারের বিভিন্ন অলিগলি ও স্পট। মাদকের স্পট থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ম্যাসেজ পার্লার, জুয়ার আখড়া, নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ বিভিন্ন বেআইনি কারবার ফের চলছে নির্বিঘ্নে।

চকবাজারে নানা অপরাধের আখড়া হিসেবে পরিচিত কালাম কলোনি। পুলিশের তৎপরতায় মাদক ব্যবসা, জুয়ার আখড়াসহ পেশাদার অপরাধীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে ছিল এতদিন। সম্প্রতি ক্যাশিয়ার অলির যোগসাজশে কালাম কলোনিতে ইয়াবা ও গাঁজার স্পট পুরোদমে চলছে। জুয়ার আসর বসছে নিয়মিত। সংশ্লিষ্ট থানার নামেই এখান থেকে মাসে ৬০ হাজার টাকা মাসোহারা পান ক্যাশিয়ার অলি। আর চক্রের হয়ে মাদক কারবারি ডালিম প্রতি মাসে তিন ভাগে এ টাকা পরিশোধ করেন অলিকে। অলির সহকারী হিসেবে চাঁদা তোলে মামুনসহ বেতনভুক্ত কর্মচারীরা।

এছাড়া ডিসি রোড এলাকায়ও হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজা, চোলাই মদসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। চাঁনমিয়া মুন্সি লেনে মাদকস্পট পরিচালনা করছেন মহিউদ্দিন। পুলিশের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সখ্যতা রয়েছে। অলিকে মাসোহারা দেওয়ায় এ স্পটে পুলিশের অভিযান এবং কাউকে গ্রেপ্তারের রেকর্ড নেই।

এদিকে বিউটি পার্লারের আড়ালে গোলপাহাড় থেকে মেহেদীবাগ সড়কে গড়ে ওঠেছে বেশ কয়েকটি ‘নিষিদ্ধ’ ম্যাসেজ পার্লার। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে দীর্ঘদিন। আর ক্যাশিয়ার অলি মাস শেষে প্রত্যেক স্পট থেকে ৫০-৬০ হাজার টাকা মাসোহারা তোলেন।

চকবাজারের ডিসি রোড হয়ে বাকলিয়া এলাকায় প্রায় ৩০০ নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। সম্প্রতি এসব গাড়ি উচ্ছেদ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন ট্রাফিক পুলিশ। এ ঘটনায় চকবাজার থানায় মামলাও হয়। এরপর থেকে চকবাজার ও বাকলিয়া থানাকে ম্যানেজ করে মাসে অন্তত আট লাখ টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। আর মাস শেষে থানার কথিত ক্যাশিয়ার অলিসহ অন্যের হাতে পৌঁছে যায় মাসোহারা।

চকবাজারের ধুনিরপুল থেকে ফুলতলা সড়ক-ফুটপাত দখল করে কিছু চক্র কাঁচাবাজার বসিয়েছে। থানা পুলিশের নামে নিয়মিত দোকান প্রতি দৈনিক ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়৷ আর এ টাকার ভাগ যায় ক্যাশিয়ার অলির হাতেও। বছরের পর বছর চাঁদাবাজির কারবার চলছে অলি উদ্দিনের। তবে বরাবরের মতোই কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন।

এ বিষয়ে চকবাজার থানার ওসি মো. মনজুর কাদের মজুমদার বলেন, ‘আমি এ থানায় নতুন এসেছি। ক্যাশিয়ার বা মেস ম্যানেজার অলি নামের কাউকে চিনি না। তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখছি। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অভিযোগ বিষয়ে জানতে কথিত ক্যাশিয়ার অলি উদ্দিন হাওলাদারের মুঠোফোন যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!