চট্টগ্রামের ৩৫০০ ব্যবসায়ীর দখলে অবৈধ স্বর্ণের বাজার

বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মার্কেটগুলোতে গড়ে উঠেছে স্বর্ণের দোকান। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউজের সুযোগ থাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ে সমৃদ্ধি ঘটছে চট্টগ্রামে। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। তবে প্রশাসনের উদাসীনতায় চট্টগ্রাম মহানগরে স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসায়ীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ট্রেড লাইসেন্স, ডিলিং লাইসেন্স, ভ্যাট, আয়কর, টোকেনের আওতার বাইরে থেকে গেছেন এসব ব্যবসায়ী। এর ফলে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। ফলে সহজে পার পেয়ে যাচ্ছেন স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসায়ীরা। এ সব ব্যবসায়ীকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি অন্য ব্যবসায়ীদের। সরকারি রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ‘স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসায়ীদের সঠিক পথে আনার কাজটি করতে হবে সমিতিকে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমত ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে দামও ইচ্ছেমতো আদায় করছেন। সমিতির সদস্যও হয় না তারা। কোন কিছুর তোয়াক্কা করেন না এসব ব্যবসায়ী। এমনকি নোটিশ দিলেও সমিতির সদস্য হতে অনাগ্রহী তারা।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর কেসিদে রোড, দিদার মার্কেট, চকবাজার, মিমি সুপার মার্কেট, বিপণি বিতান (নিউমার্কেট), আলকরণ রোড, হাজারী লেইন, চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স, লাকি প্লাজা, আখতারুজ্জামান, বন্দর টিলা, ফ্রি পোর্ট, কাটগড়, স্টিল মিল বাজার, কালুরঘাট, সেন্ট্রাল প্লাজা, আমিন সেন্টার, বায়েজিদ, সিডিএ অলংকার মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় ও মার্কেটে স্বর্ণের দোকান রয়েছে।

সম্প্রতি নগরে অনুষ্ঠিত স্বর্ণমেলায় বাংলাদেশ জুয়েলারী সমিতি চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি মৃণাল কান্তি ধর জানিয়েছেন ‘চট্টগ্রাম মহানগরে প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ জুয়েলারি দোকান আছে। এর মধ্যে মাত্র বৈধ দোকান এক হাজার ৭০০টি।’

সে হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় তিন হাজার ৫০০ জন স্বর্ণের ব্যবসায়ী অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ সব ব্যবসায়ীর ট্রেড লাইসেন্স, ডিলিং লাইসেন্স, বিএসটিআইয়ের টোকেন নেই। তারা আয়কর ও ভ্যাটেরও আওতার বাইরে।

জানা যায়, স্বর্ণের ব্যবসায় পরিচালনা করার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে ডিলিং লাইসেন্স, সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই থেকে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। বিক্রয়ের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট এবং আয়ের ওপর আয়কর দিতে হয়।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডিলিং লাইসেন্স গ্রহণের জন্য এককালীন জমা দিতে হয় ১৪ হাজার টাকা। প্রতি বছর নবায়ন ফি ১০ হাজার টাকা। ট্রেড লাইসেন্সের জন্য এককালীন ফি দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, প্রতি বছর নবায়ন ফি ৪ হাজার টাকা। প্রতিটি মেশিনের জন্য বিএসটিআই থেকে প্রতিবছর টোকেন নিতে হয়ে ২০০ টাকা দিয়ে।

হিসাব মতে, নগরীর তিন হাজার ৫০০ জন স্বর্ণের ব্যবসায়ীকে ট্রেড লাইসেন্স, ডিলিং লাইসেন্স ও টোকেনের আওতায় আনা গেলে সরকার এককালীন রাজস্ব পাবে প্রায় ৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর প্রতি বছর নবায়ন ফি পাওয়া যাবে প্রায় ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর বাইরে রয়েছে ভ্যাট ও আয়কর।

মৃণাল কান্তি ধর দাবি করেছেন, ‘ভ্যাট, আয়কর, চসিকের ট্রেড লাইসেন্স এবং জেলা প্রশাসনের ডিলিং লাইসেন্স ফি দেওয়ার পরও প্রকৃত স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা হয়রানির মুখে পড়ছেন। কর অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যারা করের আওতায় নেই, তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

জুয়েলারী সমিতি চট্টগ্রাম শাখার এই সভাপতি বলেন, ‘অনেক নোটিশ ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও তারা (অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ী) সমিতির সদস্য হচ্ছে না। আমার কাছে পুলিশ নেই, কোন ক্ষমতা নেই। মেয়র ও ডিসির কাছে ক্ষমতা আছে। এটা উনাদের ব্যাপার। যাদের ডিলিং লাইসেন্স ও ট্রেড লাইসেন্স নেই, তাদেরকে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের।’

এ ব্যাপারে কাস্টম, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সব সময় লক্ষ্য থাকে ব্যবসায়ীদের টার্নওভারের ওপর ভ্যাট আদায় করা। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য আমরা এটা আদায় করার চেষ্টা করে থাকি। ভ্যাটের আওতায় নেই—এমন স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা আছে।’

চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগের কর অঞ্চল-৪ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মো. মফিজ উল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবৈধ ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার জন্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতিকে বলেছি। আমরা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে এরপর থেকে আমরা স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবো। এছাড়া ব্যবসায়ীদেরকে আয়করের আওতায় আনার জন্য আমাদের জরিপের কাজ চলছে। জরিপের মাধ্যমেও আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

যোগাযোগ করা হলে স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীর বলেন, ‘ব্যাপারটি আমরা দেখবো। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেবো।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা এ বিষয়ে বলেন, ‘এ রকম কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্সের আওতায় আনার জন্য সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা নিয়োজিত আছে। আমরা এ ব্যাপারে খোঁজ নেবো। অভিযোগ সত্যি হলে করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!