চট্টগ্রামের ১৫০ স্কুল থেকে স্ট্যাম্পে জোর করে সই নিচ্ছে শিক্ষাবোর্ড, হঠাৎ ‘জুলুমে’ ক্ষোভ (অডিওসহ)

১০ মিনিটের অডিওতে উপসচিবের কাণ্ডে বিস্ময়

চট্টগ্রামের ১৫০টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জোর করে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিরুদ্ধে। অননুমোদিত বিদ্যালয়গুলোর বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষিতে এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু এই বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়নি বলে জানায় চট্টগ্রাম কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন।

চট্টগ্রাম কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা ছাড়াই জুলুম করছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। দেশের সকল শিক্ষা বোর্ডে সরকার বিনামূল্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বই দিয়ে যাচ্ছে। কারো কোনো অভিযোগ নেই। হঠাৎ করে এই ধরনের জুলুমে ক্ষোভ বাড়ছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর সিঅ্যান্ডবির শাহ জব্বারিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।

একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফরম পূরণের জন্য ১৮ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ওই বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী বাড়তি টাকা নেওয়ায় অভিযোগ করলে নড়েচড়ে বসে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড।

শিক্ষার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে শাহ জব্বারিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষকে শিক্ষা বোর্ডে ডাকলেও তারা আসেনি। পরে শিক্ষা বোর্ড অনুমোদনহীন বিদ্যালয়টি যে অনুমোদিত বিদ্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে, সেই বিদ্যালয়কে ডেকে পাঠায়।

শিক্ষা বোর্ডের কন্ট্রোলার এই বিষয় নিয়ে দুর্ব্যবহার করেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। এছাড়া জোর করে ৩০০ টাকা মূল্যের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও নেন। এ ঘটনায় ১০ মিনিটের একটি অডিও রেকর্ড চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড বলছে, বাইরের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর রেজিস্ট্রেশন করানো যাবে না, এই অঙ্গীকারে ৩০০ টাকা মূল্যের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে হবে। এছাড়া অনুমোদন ছাড়া ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পাঠদান করানো যাবে না। যেসব অনুমোদনহীন বিদ্যালয় আছে, সবাইকে ৩০০ টাকা মূল্যের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে হবে। তা নাহলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত বন্ধ করা হবে।

অন্তত ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জোর করে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এই ধরনের কোনো নির্দেশনা আসেনি বলে জানা গেছে।

শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিজস্ব ২১ শতক জায়গায় যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, তারাই অনুমতি পাবে পূর্ণাঙ্গ পাঠদানের। শিক্ষা বোর্ড নীতিমালার নতুন শর্ত হচ্ছে, বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ই অনুমতি নিতে হবে।

অথচ দেশে হাজার হাজার বিদ্যালয় পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে শর্ত শিথিল করে। জায়গায় না থাকার কারণে ভাড়া ঘরে শত শত বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।

চট্টগ্রামে অন্তত ১২০০ বিদ্যালয় আছে, যারা এসব অনুমতি শিথিল করে পাঠদান চালাচ্ছে ৷ অনুমোদিত বিদ্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে অননুমোদিত বিদ্যালয়গুলো এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।

এদিকে নগরীর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জমি ছাড়া ভাড়া ঘরে মন্ত্রণালয় থেকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে পতেঙ্গা আইডিয়াল স্কুল, অক্সিজেনের হলিচাইন্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুরের লাইমলাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আগ্রাবাদ চৌমুহনীর অক্সফোর্ড মর্ডান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঈদগাঁ পাহাড়তলীর অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরাইপাড়ার ইডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পতেঙ্গায় সি ভিউ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিইপিজেডের ওশান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চান্দগাঁওয়ের আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল, লিবার্টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ শামীম মোর্শেদ একাডেমিসহ আরো অনেক বিদ্যালয়কে। মোটা অংকের ‘ঘুষ’ খেয়ে এসব বিদ্যালয়গুলোকে ভাড়া ঘরে কার্যক্রম পরিচালনা অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ওপর শিক্ষা বোর্ড এক ধরনের জুলুম চালাচ্ছে। সারাদেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধিকাংশই শিক্ষা বোর্ডের শর্ত শিথিল করে চলছে এবং চলতে বাধ্য। ২১ শতক জায়গা, অবকাঠামো—এসব কি অনেক সহজ? কিভাবে এত জায়গা পাব আমরা? এই শহরে এত জায়গা আছে? এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে শিক্ষার্থীদের গতি কি হবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের যদি শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেই দেবে না; তাহলে সরকার কেন বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকেও বিনামূল্যে বই দিচ্ছে? মন্ত্রণালয় থেকে কোনো রকম লিখিত নির্দেশনা ছাড়াই এক প্রকার জুলুম করছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড।’

ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিদিন ডেকে ডেকে জোর করে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিচ্ছে। এসবে এখন অতিষ্ঠ হয়ে আন্দোলন কর্মসূচির ডাক দিতে চাচ্ছি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ড আছে। কোনো শিক্ষা বোর্ডে এই ধরনের জুলুম হচ্ছে না। এরা জোর করে শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য এবং আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য, আমাদেরকে বন্ধ করার জন্য; মনগড়া সিদ্ধান্তে ভোগান্তি করছে। এই ঘটনার জন্য শীঘ্রই সারাদেশে আন্দোলন হবে। চট্টগ্রাম থেকেই আন্দোলন শুরু হবে।’

এই প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মুস্তফা কামরুল আখতারকে মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানোর পরও কোনো সাড়া মেলেনি।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপ সচিব মোহাম্মদ বেলাল হোসেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারব না। আমাদের চেয়ারম্যান স্যারকে ফোন করেন। আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের কড়া নির্দেশ আছে, মিডিয়ায় কোন বক্তব্য দিতে পারব না।’

১০ মিনিটের অডিও আছে এবং সেখানেই আপনিই কথা বলেছেন, এটি কী আপনি চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশে করেছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। আপনি শিক্ষা বোর্ডে এসে চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’

এআইটি/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!