চট্টগ্রামের সার্ভিলেন্স টিমে বিতর্কিত লোক— শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা!

চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত ও তদারকি করতে বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক গঠিত সার্ভিলেন্স টিম থেকে সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী বাদ পড়লেও রয়ে গেছেন ম্যাক্স হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান। ডা. লিয়াকত আলী খান চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবায় অন্যতম একটি সমালোচিত নাম। শুধু চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশী জনসাধারণ নয়, নিজেদের শ্রম-ঘামে জমানো টাকায় গড়ে ওঠা ম্যাক্স হসপিটালের শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকদের কাছেও রীতিমতো ‘খলনায়ক’ হয়ে উঠেছেন ডা. লিয়াকত।

সাত সদস্যের সার্ভিলেন্স টিমের সদস্যদের নাম প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই চট্টগ্রামে সমালোচনার ঝড় উঠছে। অনেকেই বলছেন, এ যেন শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া। সার্ভিলেন্স টিমের ৭ সদস্যের ৫ জনই সরকারি কর্মকর্তা এবং বাকি দুজন চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবার প্রশ্নে বার বার বিতর্কের জন্ম দেওয়া চিকিৎসক। বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীকে বৃহস্পতিবার বাদ দিয়ে সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খানকে যুক্ত করা হলেও রয়ে গেছেন গেছেন ডা. লিয়াকত আলী খান।

করোনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঈদের আগে স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্মার্ট জিন্সের জিএম (এডমিন) মহিউদ্দিন জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ম্যাক্স হসপিটালে ছুটে গিয়েছিলেন। ডা. লিয়াকতের ম্যাক্স তাকে ফিরিয়ে দিলে তিনি সিটি গেইট সংলগ্ন করোনা ফিল্ড হসপিটালে যান। ফিল্ড হসপিটালে মহিউদ্দিনকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার পরপরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। স্বজনদের দাবি, ম্যাক্স যদি মহিউদ্দিনকে চিকিৎসাসেবা দিতো হয়তো বাঁচার আশা করা যেতো।

তার আগে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও ম্যাক্সের শেয়ারহোল্ডার এএসএম লুৎফুল কবির শিমুল করোনা উপসর্গ থাকায় অক্সিজেন কমে যাওয়ায় জীবনমৃত্যুর শঙ্কায় পড়েন। করোনা টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেও দ্রুত স্যাচুরেশন নেমে যাওয়ায় তিনি অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন এটা করোনার লক্ষণ। কিন্তু তিনি জেনারেল হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকায় নিজের হাসপাতালের (ম্যাক্স হাসপাতাল) কেবিনে ভর্তি হয়ে অক্সিজেনসেবা নিতে চাইলেন। নিজের কর্মস্থল ম্যাক্স হাসপাতালের এমডি ডা. লিয়াকত আলী খানকে ফোন করে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলে তিনি সোজাসাপ্টা অপরাগতার কথা জানিয়ে ফোন কেটে দেন।

এমন অমানবিক অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই বিতর্কিত ব্যক্তিই যদি মনিটরিং টিমে থাকেন, তাহলে করোনাকালে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবার আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। নিজের প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া, চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করার হাজারও অভিযোগে অভিযুক্ত ডা. লিয়াকত। এ ছাড়া ঈদের দুদিন আগে নিজ প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতা না দিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকিও দেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা।

ডা. লিয়াকত আলী খানের ম্যাক্স হসপিটাল সাংবাদিক রুবেল খানের শিশু কন্যা রাইফাকে ভুল চিকিৎসায় হত্যার অভিযোগে আদালতে বিচারাধীন আছে একটি মামলা। ওই ঘটনায় চকবাজার থানায় সাংবাদিক ও ম্যাক্সের কর্তৃপক্ষের বৈঠক চলাকালে থানায় ঢুকে ওসি আবুল কালামকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিলেন ডা. ফয়সাল। সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে অসদাচরণ করার অভিযোগও আছে ডা. ফয়সালের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেও সমালোচিত হন ডা. ফয়সাল ইকবাল। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপির বিরুদ্ধেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে বিতর্কিত হন চিকিৎসক নেতা ফয়সাল।

নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল নিজ দলের এমপি-মন্ত্রীসহ দায়িত্বশীল নেতাদের সাথে বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের অভ্যন্তরেও ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে।

গত ৩০ জানুয়ারি চমেক হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তাসনুভা তানজিলকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের টিচার্স লাউঞ্জে ডেকে নিয়ে বিএমএ সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী ‘বেয়াদব’ বলে শাসান। ওই অভিযোগ তুলে তিনি চমেক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে পাঠানো আবেদনে লিখেন, ‘এই অবস্থায় আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমার বিভাগে কর্তব্য পালনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

ছাত্রজীবন থেকেই বেপরোয়া ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী হত্যামামলাসহ একাধিক মামলার আসামিও ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রথমবার বিএমএ সাধারণ সম্পাদকের পদে জিতেছিলেন প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্রের মুখে ব্যাটল বক্স ছিনতাই করে। সেই থেকে বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদকের পদ ব্যবহার করে চিকিৎসকদের পদায়ন বাণিজ্যের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের গভর্নিং বডির সর্বশেষ নির্বাচনে মাত্র ১০ ভোট পেয়েছিলেন বিতর্কিত ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ মে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে কভিড-১৯ ও নন কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ও তদারকি করার জন্য সাত সদস্যের একটি সার্ভিলেন্স কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিস। কমিটিতে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (উন্নয়ন) আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদ্যরা হলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর), অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক। এক সপ্তাহের মাথায় এসে বিএমএ সাধারণ সম্পাদকের পরিবর্তে সভাপতি সম্পৃক্ত হলেও রয়ে গেলেন আরেক বিতর্কিত চিকিৎসক ডা. লিয়াকত আলী খান।

এফএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!