চট্টগ্রামের সাইলোতে গম চুরির যতো কৌশল

দেশের আমদানিকৃত গম খালাসের সবচেয়ে বড় স্থাপনা চট্টগ্রামের সাইলো জেটিতে অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘটছে গম চুরির ঘটনা। সঙ্গে আছে নানামুখী অনিয়ম। চুরি ও অনিয়ম দেখার যেন কেউই নেই। দিনের পর দিন চুরির ঘটনা ও অনিয়মের কারণে অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন আমদানিকারকরা।

আমদানিকৃত গম জাহাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খালাস করার সবচেয়ে বড় স্থাপনা হচ্ছে চট্টগ্রাম সাইলো। এখানে জাহাজ থেকে সরাসরি গম খালাস করে গুদামজাত করা হয়। এক লাখ টন ধারণক্ষমতার এই সাইলো জেটিতে তিনটি নিউমেটিক আনলোডার দিয়ে জাহাজের হ্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম খালাস করে গুদামজাত করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, সাইলো জেটিতে মাদার ভ্যাসেল ভেড়ানো হলে সেখান থেকে গম আনলোড শেষ না করেই নারায়ণগঞ্জ পাঠানোর জন্য লাইটার জাহাজে লোড করা হয়। দিনের পর দিন দাঁড় করিয়ে রাখা হয় মাদার ভ্যাসেলকে। এতে মাদার ভ্যাসেলকে দৈনিক ১৭ হাজার ডলার— বাংলাদেশি মূদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা লোকসানে পড়তে হয়। অথচ মাদার ভ্যাসেল না থাকলেও লাইটারে করে নারায়ণগঞ্জের সাইলোতে গম পাঠানো যায়। সেটি না করে সাইলোর কর্মকর্তারা মাদার ভ্যাসেল ভিড়লে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে গম লোড করানোর তোড়জোড় শুরু করেন। এখানেই হয় বড় ধরনের গম চুরির ঘটনা।

মাদার ভ্যাসেল থেকে নিউমেটিক আনলোডার দিয়ে জাহাজের হ্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম খালাস করে গুদামজাত করার সময় সাইলো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লাইটার জাহাজে অতিরিক্ত বোঝাই করে চুরি করা হয় গম। যা নারায়ণগঞ্জ নেওয়ার পথে চাঁদপুরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার নারায়ণগঞ্জের সাইলোতে কম না পড়ে মতো ওজনে সমান রাখা হয়। পথে কৌশলে পাচার হয়ে যায়। এতে লাইটারে অতিরিক্ত বোঝাই করা গম মাদার ভ্যাসেলে আমদানি করা গমের ওজনে কম পড়ে।

ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশ থেকে আমদানি করা গম চট্টগ্রাম সাইলোতে এলেই ৫০০ থেকে ১ হাজার মেট্রিক টন কমে যায়। এই গম সাইলোতেই চুরি হয় এভাবে। এতে ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে।

এদিকে সাইলোতে গম বোঝাই মাদার জাহাজ ভিড়লে সেটি থেকে অর্ধেক গম আনলোড করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দিনের পর দিন। এতে বন্দরের চার্জ ও জাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের।

অপরদিকে জাহাজের গম খালাসের জন্য শ্রমিক, বন্দরের স্টাফ, স্টিভিডোর ও সাইলো অপারেটদের ২৪ ঘন্টায় তিন শিফটে দৈনিক ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। অথচ তারা সরকারি বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। এসব নানা অনিয়মের কারণে লোকসানের শিকার হন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সাইলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য ব্যবসায়ীদের দাবি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম সাইলো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বেশ কয়েক বছর আগে স্থাপিত তিনটি নিউমেটিক আনলোডার (ভিগান বোম) দিয়ে দৈনিক গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টন গম খালাস করা যায়। কিন্তু গম খালাস প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা কমে যাওয়ায় পুরানো একটি নিউমেটিক আনলোডার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই আলোকে বেলজিয়ামের ভিগান কোম্পানি থেকে প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা দিয়ে নতুন একটি আনলোডার আমদানি করা হয়। কিন্তু তা দিয়ে এখনো কাজ শুরু করা হয়নি।

সরেজমিনে মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে সাইলো সেটিতে গেলে দেখা যায়, রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশ সরকারের জিটুজি চুক্তিতে আমদানিকৃত ৫২ হাজার ৫০০ টন গম নিয়ে রাশিয়া থেকে গ্রিসের পতাকাবাহী এমভি কমন ফেথ নামের জাহাজ থেকে গম খালাস করা হচ্ছে। জাহাজটি গত ২৩ নভেম্বর কতুবদিয়ার অদূরে নোঙর করে। জাহাজটি থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে ১৯ হাজার ২২১ টন গম খালাস হয়েছে। চট্টগ্রামের সাইলোতে ১২ হাজার ২৭৮ টন গম খালাস করে বাকি গম নিয়ে জাহাজটির মংলায় যাওয়ার সিডিউল রয়েছে। কিন্তু সাইলো জেটি পুরোপুরি গম খালাস না করে জাহাজটি দাঁড় করিয়ে রাখে আরও একদিন। এতে ওই জাহাজের মালিককে ১৭ হাজার ডলার ক্ষতি গুণতে হল। ১৯০ ফুট লম্বা এ মাদার জাহাজটি থেকে আনলোড না করে হ্যাজে রেখে দেওয়া হয়েছে আরো সাড়ে তিন হাজার টন গম। দেখা গেছে, জাহাজটি থেকে গম খালাস কাজ শেষ না করে লোড করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ নেওয়ার লাইটার জাহাজ।

সাইলো জেটিতে দেখা যায়, লাইটার জাহাজে এমভি বাশার-১০ এ গম লোড হচ্ছে। পাশে নোঙর করা আছে এমভি সোনিয়া-১০। সেটিতেও লোড করা হবে গম।

জানতে চাইলে লাইটার এমভি সোনিয়া টেনের শ্রমিক বাবুল তালুকদার বলেন, নারায়ণগঞ্জ নেওয়ার জন্য লাইটার জাহাজ লোড করা হচ্ছে। প্রতিটি জাহাজে ১২০০ টন করে লোড দেওয়া হচ্ছে। ওজন মাপার জন্য কোন ডিজিটাল স্কেল নেই। পানিতে জাহাজের গভীরতার ছাপ থেকে মাপা হয় ওজন।

অথচ লাইটার জাহাজ লোড দেওয়ার জন্য মাদার জাহাজটিকে একদিন অলস বা বাড়তি সময় কাটাতে হচ্ছে শুধুই সাইলো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। এতে ব্যবসায়ী ও সরকারের ক্ষতি হলেও সাইলো কর্মকর্তাদের লাভ হয় বেশি।

সরকারি গম আমদানিকারক সাপ্লাইয়ার এজেন্ট সেভেন সিস শিপিং লাইনের সিইও মোহাম্মদ আলী আকবর বলেন, সাইলো জেটিতে বিদেশি জাহাজ অলস পড়ে থাকলে আমাদের চরম আর্থিক ক্ষতি হয়। বিষয়টি আমরা উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে বার বার জানিয়েছি। কিন্তু কোন প্রতিকার পাইনি। বিদেশ থেকে আমদানি করা গম চট্টগ্রামের সাইলোতে এলে ৫০০ থেকে ১ হাজার টন গম কমে যায়। এতে ব্যবসায়ীদের লোকসানে পড়তে হচ্ছে।

সাইলো জেটির সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সাইলোর বেল্টে ইট বা কাঠ বসিয়ে গম চুরি করা বিষয়টি সত্য নয়।

তিনি বলেন, বিদেশি জাহাজগুলো থেকে যে পরিমাণ গম আমরা পাই, সেটি ঘোষণা দিই। কিন্তু তারা কী পরিমাণ নিয়ে এসেছে সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। সাইলো খালি করার জন্য নারায়ণগঞ্জে আনলোড করা হয়।

বড় জাহাজের আনলোডের ব্যাঘাত না ঘটিয়েও বড় জাহাজ জেটিতে না থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ পাঠানো যায় কিনা— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদার ভ্যাসেল ভিড়লে লাইটার জাহাজ ভেড়ানো হয়। এ অর্ডার নিয়ে আসে ঢাকা থেকে। এখান থেকে আমরা চাইলেই অর্ডার দিতে পারি না।

এএস/এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!