চট্টগ্রামের শিল্পপতি-কন্যা ঢাকায় অভিজাত মাদকচক্রের ‘গডমাদার’, বয়স মাত্র ২৩

লেখাপড়া ছেড়ে ভারত থেকে ফিরেই জড়িয়ে যান মাদকচক্রে

চট্টগ্রামের এক সুপরিচিত ধনাঢ্য শিল্পপতির কন্যা তিনি। বয়স মাত্র ২৩। অন্ধকারজগতে সবাই তাকে চেনেন ‘ইডেন ডি সিলভা’ নামে। তবে তার আসল নাম রামিসা শিমরান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তরুণীর ফাঁদে পড়েই অনেকেই হারিয়েছেন প্রায় সর্বস্ব। অনেকের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়ে আসছিলেন চট্টগ্রামের এই তরুণী রামিসা। প্রয়োজনে আবার ব্ল্যাকমেইল করতেও ছাড়েননি। তার মূল আস্তানা ঢাকাতেই। রাজধানীর গুলশানকেন্দ্রিক বিত্তশালীদের সঙ্গে তার দহরম-মহরম। চার বছর আগে গুলশানের এক পরিবার তার বিরুদ্ধে দামি ঘড়ি ও ডায়মন্ডের আংটিসহ মোট ৩৬ লাখ টাকার মালামাল চুরি করার অভিযোগে থানায় মামলা করেছিল। পুলিশ তখন তাকে গ্রেপ্তারও করে।

রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন পার্টি এবং ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সংঘবদ্ধ একটি চক্রের আট সদস্যকে গত ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর চার দফা অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা। গ্রেপ্তার এই আটজনের অন্যতম হলেন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য শিল্পপতির কন্যা রামিসা শিমরান। আরও পাঁচ সহযোগীসহ রামিসাকে গ্রেপ্তার করা হয় গত ৭ ডিসেম্বর।

ঢাকায় রামিসার আরেক পরিচয়— তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত সুব্রত বাইনের একসময়ের সহযোগী রাসেল ওরফে ভাইস্তা রাসেলের বান্ধবী। অভিযানে এই রাসেল ছাড়াও গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন রুবায়েত আলী, নাসিম ইকবাল অপু, সৈয়দ নওশাদ, আলভী জাবরান, প্রিন্স রহমান ও সাদী রহমান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কন্যা রামিসা শিমরান কয়েক বছর আগে ভারতে লেখাপড়া করতে যান। কিন্তু লেখাপড়া শেষ না করেই একপর্যায়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপরই রামিসা জড়িয়ে পড়েন মাদকচক্রে। রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন পার্টিতে মাদক সরবরাহ করতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সহযোগী ভাইস্তা রাসেলের সঙ্গে।

রামিসার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তিনি অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ঢাকার এক সংসদ সদস্যের ছেলে তার ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন অনেক কিছু, পড়েছেন মাদকের খপ্পরেও। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও মিরপুরসহ একাধিক থানায় এই তরুণীর নামে মামলা ও জিডি রয়েছে।

২০১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে গুলশান থানা পুলিশ রামিসাকে এক চুরির মামলায় আটক করে। সেই মামলার বিবরণীতে জানা যায়, গুলশানের এক ধনাঢ্য পরিবারের সঙ্গে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ইডেন ডি’সিলভা ওরফে রামিসার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে তিনি বিভিন্ন সময় ওই পরিবারে যাওয়া আসা করতেন। এর মধ্যে পর পর দুই মাসে ওই বাসা থেকে তিন লাখ টাকা মূল্যের একটি ডায়মন্ডের আংটি এবং ২৮ লাখ টাকা মূল্যের সুইজারল্যান্ডের তৈরি হাবলট ব্র্যান্ডের ঘড়ি হারিয়ে যায়। পরে গুলশানের বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে ইডেন ডি’সিলভা ওরফে রামিসার হাতে ঘড়িটি দেখতে পাওয়া যায়।

ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়, রামিসা বিভিন্ন সময়ে ব্যবহারের কথা বলে অনেক মূল্যমান ব্র্যান্ডের জুতা, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি নিয়ে আর ফেরত দেননি। যার আনুমানিক মূল্য পাঁচ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে ৩৬ লাখ টাকার মালামাল ‘লুণ্ঠন’ করা হয়েছে বলে সেই মামলার বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়।

রামিসা-রাসেল মাদকচক্রের যে কয়েকজন সদস্য সম্প্রতি ধরা পড়েন, তাদের মধ্যে বিত্তশালী ঠিকাদার বাবার সন্তান রুবায়েত আলী ২০১১ সালে যুক্তরাজ্য থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে মাদকচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে ব্যবসায়ী বাবার সন্তান সৈয়দ নওশাদ ২০০৩ সালে মালয়েশিয়া থেকে পড়ালেখা শেষ না করেই দেশে ফিরে চক্রটির সঙ্গে যুক্ত হন।

এই মাদকচক্রের সদস্যরা রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন পার্টি ছাড়াও মাদক সরবরাহ করতেন বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের কাছে। অন্তত পাঁচ বছর ধরে তারা অপ্রচলিত বিভিন্ন মাদক দেশে এনে ‘বাণিজ্য’ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী মাদক ক্রিস্টাল মেথ ও আইস ছাড়াও বিশেষ এক ভয়ংকর মাদক। অপারেশনের আগে রোগীকে ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া চেতনানাশক কেটামিনকে একাধিক রাসায়নিক মিশিয়ে মাদকে রূপান্তর করে তারা বিভিন্ন পার্টিতে সরবরাহ করে আসছিলেন। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের কাছে মাদক সরবরাহের জন্য এই চক্রটি সনাতন পদ্ধতি এড়িয়ে টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন।

সংঘবদ্ধ এই মাদকচক্রের সদস্যরা আগে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা নিয়ে গিয়ে ঢাকার অভিজাত এলাকার পার্টিতে সরবরাহ করলেও গত অন্তত পাঁচ বছর ধরে তারা অপ্রচলিত মাদক আইস নিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তারা চেতনানাশক কেটামিনকে মাদকে রূপান্তর করে সেটাও পার্টিগুলোতে সরবরাহ করে আসছিলেন।

গ্রেপ্তার হওয়া সৈয়দ নওশাদ এই মাদক তৈরির মূল কারিগর। মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করতে গিয়ে তিনি নতুন এই মাদক তৈরির কৌশল শেখেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় আয়োজিত বিশেষ পার্টিতে যাওয়া তরুণীদের অগোচরে কোমল পানীয়ের সঙ্গে ওই মাদক খাইয়ে দেওয়া হতো। গত ৮ ডিসেম্বর ২ গ্রাম কেটামিনসহ নওশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!