চট্টগ্রামের লোক হাসানো ‘ম্যারা মিয়া’ দিলীপের দিন কাটছে বিছানায়, অর্থসংকটে চিকিৎসাও চলছে না

‘আঁর বাইক্ক্যা টিয়্যা দে’, ‘ও জ্যাডা ফইরার বাপ’—চট্টগ্রামে শেফালি ঘোষের কণ্ঠে এমন গান শুনে বড় হয়নি এমন মানুষ হয়তো সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শেফালি ঘোষের এই চিরঞ্জীবী গানগুলোকে যে মানুষটি অভিনয়ের মাধ্যমে প্রাণ দিয়েছেন তিনি হলেন চট্টগ্রামের কিংবদন্তী কৌতুক অভিনেতা দিলীপ হোড়। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তিনি কখনও ‘মিডা চুনচুনইন্ন্যা’, আবার কখনো ‘ম্যারা মিয়া’ নামে পরিচিত। যে মানুষটি অভিনয় দিয়ে মানুষ হাসাতো, তার পরিবারে বইছে এখন কষ্টের জোয়ার। অর্থের অভাবে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় শয্যাশায়ী এই প্রথিতযশা অভিনেতা।

হৃদরোগ ও শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিনের অভাবে গত একমাস ধরে শয্যাশায়ী দিলীপ হোড়। এমনকি হাঁটা-চলা এবং কথা বলাও বন্ধ তার। সারাদিন কাটছে বিছানায় শুয়ে।

আঞ্চলিক গান বা নাটক ছাড়াও এই শিল্পী অভিনয় করেছেন ৯০ দশকের ইলিয়াছ কাঞ্চন, জসিম, আনোয়ার হোসেনদের মত গুণি অভিনেতাদের সঙ্গে। ‘রাজা গুণ্ডা’, ‘চরম আঘাত’, ‘মহাশক্তি’র মতো সেসময়ের ব্যাবসা সফল সিনেমাতে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে হাসিয়েছেন দেশের মানুষকে। এছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন ‘রেড ড্রাগন টু রজনীগন্ধা’ বা ‘তক্ষক’র মতো জনপ্রিয় বাংলা নাটকে।

চট্টগ্রামের এই দিলীপ হোড়ের জনপ্রিয়তার কারণে হানিফ সংকেতের পরিচালিত ‘কথায় কথায়’ অনুষ্ঠানেও করা হয়েছিল প্রতিবেদন।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ক্যাসেট ‘হেডমাস্টার’ অ্যালবামের গান ও দিলীপ হোড়ের ‘ম্যারা মিয়া’ চরিত্রের অভিনয় এখনও দর্শকদের মনে সতেজ রয়েছে।

মানুষ হাসানো এই কৌতুক অভিনেতার পরিবারের মুখের হাসিই যেন বদলে গেলো এক পলকে। হঠাৎ সপ্তাহ দুয়েক আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর থেকেই হাঁটা-চলা ও কথা বলা বন্ধ তার। একবার ডাক্তার দেখানো হলেও অর্থাভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির এই অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।

চট্টগ্রামের পটিয়া ধলঘাটের সন্তান দিলীপ কাজের তাগিদে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। বর্তমানে নগরীর দেওয়ানবাজার এলাকায় দুই রুমের একটি ছোট বাসায় স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভাড়ায় থাকেন তিনি।

চলচ্চিত্রের রঙিন জগতে টাকার অভাব দেখে অনেক আগেই অন্যকিছু করার তাগদা দিয়েছিল পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু কারো কথা না শুনেই সারাজীবন ক্যামেরা আর কৌতুককে আঁকড়ে রেখেছেন জানিয়ে দিলীপের ছেলে অন্তর হোড় বলেন, ‘অভিনয় বাদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার কথা মা অনেকবার বললেও অভিনয়ের পিছু কখনো ছাড়তে পারেননি বাবা।’

করোনার আগে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করলেও করোনার সময় চাকরি যাওয়ার পর এখনও বেকার তিনি। ছোটবোন লেখাপড়া করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিভাবে চলছে পরিবার ও বাবার চিকিৎসা—উত্তরে অন্তর বলেন, ‘আগে যে সেভিংস ছিল, তা থেকে খরচ করতে করতে বর্তমানে শেষের দিকে। তাছাড়া পরিচিত আত্মীয়, বন্ধুদের থেকে টাকা ধার করে কোনো রকমে চলছে বাবার চিকিৎসা।’

সারাজীবন মানুষকে হাসিয়ে গেলেও এই মানুষটির হাসির কারণ কেউ হচ্ছেন না বলে জানান ছেলে অন্তর।

অন্তর বলেন, ‘আমার বাবা একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কেউই তাকে দেখতে আসেননি, করেননি কোনো সাহায্যও।’

কথা বলার মত পরিস্থিতি নেই দিলীপের। তারপরও যখন প্রশ্ন করা হয়, সুস্থ হলে আবার অভিনয় করবেন কিনা—তখনই বিছানায় শুয়ে হাত নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানান।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে আশীর্বাদ ও সহযোগিতা চেয়েছেন দিলীপের পরিবার। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি সাহায্য করতে চান তবে ইউনাইটেড কর্মাসিয়াল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার (০০৪৩২০১০০০০৫৮১৭৭) অ্যাকাউন্টে অথবা ছেলের বিকাশ পার্সোনাল (০১৮৪৪৮৪৪০০৮) নম্বরে আর্থিক সহযোগিতার আবেদনও করা হয়।

দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজসহ বিভিন্ন জনের সঙ্গে একাধিকবার বিদেশের মাটিতে অনুষ্ঠান করেছেন দিলীপ হোড়। তার ঝুলিতে রয়েছে বাংলাদেশ বেতার, চট্টগ্রাম শিল্পী কল্যাণ সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা স্মারকও। এছাড়া তাকে সম্মাননা দেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এদিকে দু’সপ্তাহ ধরে শয্যাশায়ী থাকলেও দিলীপ হোড়ের অসুস্থতার খবর তিনদিন আগেই জেনেছেন চট্টগ্রাম শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি পংকজ বৈদ্য সুজন। তিনি বলেন, আমি মাত্র পরশুই শুনেছি তিনি অসুস্থ। এখনও পর্যন্ত ওনাকে দেখতে যেতে পারিনি।’

কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হবে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সবাই সম্মিলিতভাবে বসে ওনার জন্য কিছু করা যায় কিনা দেখব, ওনার জন্য কিছু করা উচিত।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!