চট্টগ্রামের রাস্তায় গাড়ি চলে চোখের আন্দাজ ও ইশারায়, বেপরোয়া গতি কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ

গাড়িতে থাকে না গতি মাপার যন্ত্র কিংবা ড্যাশবোর্ডও

চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় বেশিরভাগ গাড়িই চলে চালকের চোখের আন্দাজে কিংবা হাতের মাপে। কিন্তু চোখের আন্দাজ নয়, গাড়ি চলার কথা স্পিডোমিটার বা গতিমাপক মিটারের সাহায্যে। গতিমাপক মিটারের মাধ্যমে গাড়ির গতিবেগ নির্ধারণ করে চালক সিদ্ধান্ত নেবেন কোন সড়কে, কী পরিস্থিতিতে এবং কত গতিতে চালাতে হবে। অথচ এসব তো দূরের কথা, অনেক গাড়িতে নেই ড্যাশবোর্ডও। বাসই শুধু নয়, এমনকি লেগুনা ও টেম্পো, মিনিবাসসহ সিএনজিচালিত গাড়িতেও ড্যাশবোর্ড নেই। ফলে চালকের ইচ্ছেমতো বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে নগরীর বিভিন্ন সড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও।

গতিমাপক যন্ত্র আছে কিনা— নগরীতে চলাচল করা বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা এমন করে হেসে উত্তর দেন, যেন এ এক তামাশার বিষয়। গত কয়েকদিন নগরীর কয়েকটি বাস টার্মিনাল ও টেম্পো স্ট্যান্ড ঘুরে চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গতিমাপক যন্ত্র কী সেটা তারা জানেনই না। কোন্ সড়কে গাড়ি কত গতিতে চলবে— সেটা নিয়েও তাদের ধারণা নেই। গতিমাপক যন্ত্র না থাকায় চালকও জানেন না গাড়িটি কত কিলোমিটার গতিতে চলছে। অথচ আইনে এই মিটার না থাকাটা বেআইনি।

নগরীর চকবাজার থেকে বারেক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত চলাচল করা এক টেম্পোর চালক শাহ আলম বলেন, ‘আন্দাজে চোখের ইশারায় আমি গাড়ি চালাই। বারিক বিল্ডিং থেকে চকবাজার পর্যন্ত সড়কে প্রতিদিনই যানজট থাকে। তাই গতি কখনোই ৩০ কিলোমিটারের উপর ওঠানো যায় না। যখন রাস্তায় যানজট থাকে না তখন ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাই।’

নগরীর ৬ নং রুটের গাড়িচালক তৌহিদ বলেন, ‘এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গাড়ি চালাই। হাতের ও চোখের আন্দাইজ সব। কোন প্রবলেম (সমস্যা) নাই।’

টেম্পো বা লেগুনা চালকদের মুখেই শুধু নয়, অটোরিকশা ও বাসচালকদেরও একই কথা। নগরীর কোনো কোনো সড়কে সর্বোচ্চ গতি লেখা থাকে। অনেক এলাকায় লেখা থাকে ‘গতি নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল’ বা ‘সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার’।
অন্যদিকে ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট দেশের মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাস-মিনিবাসের সর্বোচ্চ গতি ঠিক করা আছে ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার।

বেপরোয়া গতির কারণে নগরীর বিভিন্ন সড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। দ্রুতগতির এক তিন চাকার যান উল্টে গত ৩০ নভেম্বর সকালে নগরীর আগ্রাবাদের ডবলমুরিং থানাধীন চট্টগ্রাম বেতার ভবনের সামনে রায়হান সুলতান রিয়াদ (২৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। দ্রুতগামী ওই তিন চাকার যানটি উল্টে গেলে তাতে চাপা পড়ে ওই যুবক প্রথমে গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।

চলতি বছরের ৩১ আগস্ট বিকেলে নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন রাইফেল ক্লাব এলাকায় বেপরোয়া এক টেম্পো উল্টে গিয়ে অজ্ঞাত পরিচয় এক যাত্রী নিহত হন। এতে আহত হন আরও বেশ কয়েকজন। ওই টেম্পোটি চকবাজার থেকে যাত্রী নিয়ে নিউমার্কেট আমতলের দিকে যাচ্ছিল।

২০ সেপ্টেম্বর নগরীর সিনেমা প্যালেসের সামনে টেম্পো উল্টে মহসীন মোস্তফা আরমান (২৭) নামে এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হন।

এরকম দুর্ঘটনা নগরীতে প্রায়ই ঘটছে। আহত হওয়ার বেশিরভাগ ঘটনাতেই সাধারণত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানানো হয় না সংশ্লিষ্ট থানায়। ফলে এসব দুর্ঘটনা সম্পর্কে সঠিক তথ্যও মেলে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চালকেরা প্রকৃত অর্থে জানেনই না যে ড্যাশবোর্ড ও গতিনির্দেশক মিটার কাকে বলে এবং এর প্রয়োজনীয়তা কী? গাড়ির গতিনির্দেশক মিটার কাজ করে কিনা— সেটা দেখতে নগরীর ১০ নং রুটের এক বাসে উঠে দেখা যায়, ড্যাশবোর্ডটি ভাঙাচোরা। গতিনির্দেশক মিটার বলেও সেখানে কিছু নেই।

ওই গাড়ির চালক মোস্তফা বলেন, ‘চোখের ইশারা ভালো হলে গতিমাপক যন্ত্র লাগে না। হাতের আন্দাজও থাকতে হয় ভালো। আল্লাহর রহমতে আমার দুটোই ভালো আছে।’ একথা বলে মুখে থাকা পানের পিক জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে ফেলতে মোস্তফা আরও বলেন, ‘সব হইলো আপা অভিজ্ঞতার ব্যাপার। যার অভিজ্ঞতা যত বেশি, চোখের আন্দাজও তার বেশি।’

অলংকার থেকে লালদীঘি ৭ নং রুটে চলাচলকারী বাসচালক আলাউদ্দিন আলী বলেন, ‘গাড়ির গতি আমি চোখের ইশারাতেই মেপে ফেলি। মালিক গাড়িতে না লাগালে কিভাবে বুঝবো কোনটা গতিমাপার যন্ত্র আর কোনটা ড্যাশবোর্ড?’

বাংলাদেশের দ্য মোটর ভেহিকলস অরডিন্যান্স ১৯৮৩-এর আর্টিকেল ৭১-এর ৩ (বি)-তে গাড়ি চালানোর অনুমোদন দেওয়ার কিছু শর্ত দেওয়া আছে। সব ধরনের ‘অনুমোদনের জন্য শর্ত’ অংশে বলা আছে, ‘কোনো অনুমোদিত গাড়ি তার গতির চেয়ে বেশি গতিতে চালায় কিনা তা দেখতে হবে।’ অথচ গতিনির্দেশক মিটার না থাকায় চালকের পক্ষে সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন গতি মেনে গাড়ি চালানো অসম্ভব।

চট্টগ্রাম বিআরটিএর পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একটি গাড়ির অবশ্যই গতিমাপক মিটার থাকতে হবে। গতিমাপক মিটার না থাকলে একটি গাড়ি কখনোই রাস্তায় চলার অনুমোদন পেতে পারে না। বিআরটিএ থেকে প্রায়ই গাড়িতে স্পিডোমিটার ও ড্যাশবোর্ড না থাকায় জরিমানা করা হয়।’

জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৫২ কিলোমিটার এলাকায় স্পিডগান বা গতি পরিমাপক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করার পর দেশের অনান্য মহাসড়কে স্পিডগ্যান ব্যবহার শুরু করলেও তা কিছুদিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। গাড়ির গতিবেগ ধরার যন্ত্রের নামই স্পিডগান (স্পিড ডিটেক্টর ডিজিটাল মেশিন)। স্পিড ডিটেক্টর ডিজিটাল মেশিন (স্পিডগান) দিয়ে তাৎক্ষণিক গাড়ির গতিবেগ জানা যায়। পুলিশ বুঝতে পারে গাড়িটি নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করছে কিনা। হাইওয়েতে সর্বোচ্চ গতিসীমা থাকবে ৮০ কিলোমিটার। এই গতিসীমা অতিক্রম করলে পুলিশ চেকপোস্টে খবর পৌঁছে যায়। ধরা পড়ে যায় বেপরোয়া গতির যানবাহন। কিন্তু সদিচ্ছার অভাবে এর সুফল মিলছে না।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!