চট্টগ্রামের রবিনই দেশকাঁপানো আইয়ুব বাচ্চু, শূূন্যতার তিন বছর

আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন দেশীয় ব্যান্ড সংগীতের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল। ১৮ অক্টোবর আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। চট্টগ্রাম নগরীর স্টেশন রোডের চৈতন্য গলির বাইশ মহল্লার কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে শুয়ে আছেন এই সঙ্গীততারকা।

টিভিতে চলছিল পপসম্রাট আজম খানের গানের অনুষ্ঠান। আজম খানের দারুণ ভক্ত রবিন। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন পপসম্রাটের গান। পাশে ঝাঁকড়া চুলে বোতাম খোলা শার্টে গিটার বাজাচ্ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী গিটারিস্ট নয়ন মুন্সি। গিটারের কারুকাজ রবিনকে এমনই মুগ্ধ করলো যে, গিটারিস্ট হওয়ার প্রতিজ্ঞাই করে বসলেন।

সেই প্রতিজ্ঞা অটুট রেখে চট্টগ্রামের রবিন হয়ে ওঠলেন দেশসেরা আইয়ুব বাচ্চু— পরের ২৭ বছরে দেশের সঙ্গীতজগতে যিনি রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরণা ইউনিয়নে। ডাক নাম তার রবিন। পটিয়ার খরণায় জন্ম হলেও তিনি ছোটকাল থেকে বড় হয়েছেন চট্টগ্রাম শহরে। নগরীর ফিরিঙ্গী বাজার ও এনায়েতবাজারে তাদের বাড়ি থাকলেও তিনি থাকতেন নগরীর মাদারবাড়ির নানাবাড়িতে।

স্কুলে পড়াকালীন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন আইয়ুব বাচ্চু। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। এই দল নিয়ে পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের গানের পরিবেশনা।

আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরণা ইউনিয়নে।
আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরণা ইউনিয়নে।

পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। যোগ দেন ব্যান্ডদল ‘ফিলিংস’-এ। এই ব্যান্ড দলের সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি। ১৯৮০ সালে আইয়ুব বাচ্চু যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলসে’। টানা ১০ বছর সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

আইয়ুব বাচ্চুর নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এলআরবি। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন জয়, স্বপন আর এস আই টুটুল। শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। এলআরবির প্রথম কনসার্ট হয়েছিল ঢাকার একটি ক্লাবে। সেখানে ইংরেজি গানই পরিবেশন করেছিলেন তারা। কিছুদিন পর ঢাকার শিশু একাডেমিতে এক কনসার্টে প্রথমবারের মতো ক্লাব বা হোটেলের বাইরে দর্শকদের সামনে আসে এলআরবি।

শুরুর দিকে এলআরবির লাইনআপে ছিলেন ব্যান্ডটির দলনেতা, ভোকাল ও গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু, বেইজে স্বপন, ড্রামসে জয় ও কি-বোর্ডে এস আই টুটুল। এক সময় জয়ের স্থলাভিষিক্ত হন মিল্টন। দুই বছর পর মিল্টন পাড়ি জমান লন্ডনে। তার জায়গায় আসেন রিয়াদ। ২০০২ সালে এসআই টুটুল ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেলে স্থায়ী কোনো কি-বোর্ডিস্ট ছাড়াই গান চালিয়ে যায় ব্যান্ডটি। ২০০৬ সালে ড্রামসের হাল ধরেন রোমেল। ১৬ বছর ধরে এই লাইনআপ নিয়ে চলে এলআরবি।

১৯৯২ সালে ব্যান্ডের নামেই বাজারে আসে এলআরবি জোড়া অ্যালবাম এলআরবি-১ ও ২। এটাই দেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম। শুরুতেই এলআরবি চমক সৃষ্টি করে ডাবল ডেব্যু অ্যালবাম বের করার মধ্য দিয়ে। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি, ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’ গান গুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ ও ‘তবুও’ বের হয়। এলআরবির অন্য অ্যালবাম গুলো হলো— ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারীমন’ (১৯৯৬), ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০০), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নেই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২)।

২৭ বছরে মোট ১৪টি একক অ্যালবাম প্রকাশ করেছে ব্যান্ডদল এলআরবি। তাদের সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। এই দীর্ঘ সময় ধরে এলআরবি বেশ কিছু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছে শ্রোতাদের। আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে— সেই তুমি, রুপালি গিটার, ফেরারী মন, এখন অনেক রাত, তাঁরা ভরা রাতে, ঘুম ভাঙা শহরে, হকার, মাধবী, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, হাসতে দেখ গাইতে দেখ, কেউ সুখী নয়, উড়াল দেব আকাশে, শুনতে কি পাও, ভুলে যাও. আমি প্রেমে পড়িনি, মন চাইলে মন পাবে, চোখের জলের কোনো রঙ হয় না, মেয়ে, এক আকাশের তারা, তিন পুরুষ, তাজমহল, মন ভালো নাইরে, বেলা শেষে ফিরে এসে, ও দুনিয়ার মানুষও ভাই, একচালা টিনের ঘর, ভুলে যাও, অভিমান নিয়ে, সাবিত্রীরায়, ১২ মাস, নীলাঞ্জনা, দরজার ওপাশে, নীল মলাট, অপরিচিতা, ভাঙা মন নিয়ে তুমি, বাংলাদেশসহ আরও নানা গান।

এলআরবির ২৭ বছরের ভাঙাগড়ার খেলায় কান্ডারীর ভূমিকা পালন করেছেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও লিড ভোকাল ও গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু। একক ক্যারিয়ারে সফলও তিনি। অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে তাঁর একক কণ্ঠে। ১৯৮৬ সালে বাজারে আসে আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’। তখনও তিনি সোলস ব্যান্ডে। প্রথম অ্যালবাম খুব একটা সাড়া না পেলেও ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’ অ্যালবামে গায়ক হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু ব্যাপক পরিচিতি পান। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এই অ্যালবামের প্রায় সব গানই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে কষ্ট কাকে বলে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, অবাক হৃদয়, আমিও মানুষ গান গুলো খুবই শ্রোতা প্রিয়। পরের বছর গুলোতে সময়, একা, প্রেম তুমি কি, দুটি মন, কাফেলা, প্রেম প্রেমের মতো, পথের গান, ভাটির টানে, মাটির গানে, জীবন, সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সট্রুমেন্টাল), রিমঝিম বৃষ্টি, বলিনি কখনো’র মতো একক অ্যালবাম নিয়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেন আইয়ুব বাচ্চু।

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর রুপালি গিটার ফেলে বহুদূরে চলে যান আইয়ুব বাচ্চু। লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে যাওয়া চট্টগ্রামের সন্তান আইয়ুব বাচ্চুর শেষ ঠিকানা হয় নগরীর স্টেশন রোডের চৈতন্য গলির বাইশ মহল্লার কবরস্থান। সেখানে মায়ের কবরের পাশে শুয়ে আছেন এই সঙ্গীততারকা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!