চট্টগ্রামের যুবক ফেসবুক গ্রুপ খুলে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে পরিবারসহ উধাও (ভিডিও)

চট্টগ্রাম নগরীর একটি এগ্রো ফিড কোম্পানিতে চাকরি করতেন চট্টগ্রামের তিন যুবক—পিয়াল শর্মা, অপূর্ব আচার্য্য ও সৈকত বসু। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে হঠাৎ চাকরি চলে গেলে তিনজন সিদ্ধান্ত নেন নিজেরাই করবেন এই ব্যবসা। তাই নিজেদের জমানো টাকার সঙ্গে বিভিন্ন মানুষ থেকে ধার করে জনপ্রতি ১০ লাখ করে মোট ৩০ লাখ টাকায় ব্যবসা শুরু করেন ‘চেরিস এগ্রো’ নামে। কিন্তু টিকতে পারেননি বাজারে। বছর শেষে যখন পাঁচ লাখ টাকা লোকসান হয়ে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে, তখনই ব্যবসার দায়িত্ব নেন পিয়াল।

এরপর ব্যবসার মূলধন বাড়াতে চারজন থেকে নেওয়া হয় ৫০ লাখ টাকার শেয়ার। এদের আস্থা অর্জন করতে তিনজনের স্বাক্ষরে দেওয়া হয় খালি চেক। কিন্তু সেই একই ব্যবসা দেখিয়ে, অন্য দুই পার্টনারকে না জানিয়ে; পিয়াল নিজে বিভিন্ন মানুষ থেকে নিয়ে বসেন কোটি কোটি টাকা। এজন্য তিনি বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রত্যেককে খালি চেক দিতেন।

পিয়াল শর্মার পাসপোর্টে ভারতীয় ভিসা
পিয়াল শর্মার পাসপোর্টে ভারতীয় ভিসা

এভাবে অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে সেই পিয়াল শর্মা এখন পরিবার নিয়ে পলাতক বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, পিয়াল শর্মার এমন প্রতারণায় তার বাবা-মা ছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যদের যোগসাজশ ছিল।

তার এই জালিয়াতির খেসারত দিতে হচ্ছে দুই পার্টনারকে। টাকা ধার দেওয়া লোকজন এখন ওই দুজনের কাছে ধরনা দিচ্ছে, দায়ও চাপাচ্ছে তাদের ঘাড়ে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানায় একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে পিয়ালের নামে। এমনকি তার বিরুদ্ধে আদালতে কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে।

টাকা দেওয়া এই রকম এক ভুক্তভোগী নগরীর ইপিজেড এলাকার আশুতোষ নাথ। পিয়ালের ব্যবসায় লাভের কথা শুনে তিনিও খাটান ১০ লাখ টাকা। যার মধ্যে নিজের দুই লাখ ছাড়া বাকি ৮ লাখ টাকা আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার নেওয়া।

জানা গেছে, পিয়াল শর্মা হিন্দু সম্প্রদায়ের একশ্রেণির মানুষের কাছে খুবই বিশ্বস্ত নাম ছিল। চট্টগ্রামের অনেকে তাকে ধর্মীয় বক্তা ও সংগঠক হিসেবেও চেনেন। সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন পিয়াল। ব্যবসার ধারণা দিতে খুলেন ‘সনাতনী কর্ম উন্নয়ন সেবা’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ। যেখানে তিনি নানা ধরনের ব্যবসার ধারণা দিয়ে টাকা খাটানোর কথা বলতেন। আর সেসব ব্যবসাতে থাকতো লাখপ্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের মতো অফার। সনাতনী ভাই-বোনদের বেকারত্ব দূর করতে এবং আয়ের নতুন পথ তৈরি করতে এই গ্রুপ খোলা হয়েছে বলে প্রচার করতেন তিনি।

মানুষদের মাঝে বিশ্বাস বাড়াতে বেশ কয়েকজনকে কথা মতো লাভের টাকাও দিয়েছিলেন পিয়াল। আর সেটা দেখেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে পিয়ালের কাছে টাকা জমা দিতে। সেই টাকার পরিমাণ এক সময় কোটি ছাড়িয়ে যায়। এভাবে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে পুরো পরিবারের সঙ্গে অফিস সহযোগীসহ নিয়ে গা-ঢাকা দেন পিয়াল।

পিয়ালের পার্টনার অপূর্ব ও সৈকত বলেন, ‘আমাদের তিনজনের স্বাক্ষরে খালি চেক জমা বাবদ, যে চারজনের কাছ থেকে আমরা ৫০ লাখ টাকা নিয়েছিলাম; আমরা শুধু তাদের দায় বহন করবো। আমাদের সময় দিলে আমরা তাদের টাকা পরিশোধ করবো। কিন্তু পিয়াল ব্যক্তিগতভাবে যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, তাদের দায় আমরা নেবো না। এর মধ্যে অনেকে আমাদের চাপাচাপি করছে। কিন্তু আমরা তাদের টাকা কেন দেবো? আমরা নিজেরাইতো ভুক্তভোগী।’

ভুক্তভোগী অনেকের দাবি, পিয়াল টাকা নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে। আবার অনেকে বলছেন, তার বাবা কুয়েতপ্রবাসী। সে সুবাদে ভারত হয়ে কুয়েত পালিয়েছেন পিয়াল। তবে পিয়াল গত বছরের ডিসেম্বর ভারতীয় ভিসা পান। সেই ভিসার কপি চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।

সর্বশেষ গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর পিয়ালকে দেখা গিয়েছিল মোহরা এলাকায়। ধারণা করা হচ্ছে, ওইদিন রাতেই পালিয়েছেন তিনি।

চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকার পিয়ালের ভাড়া বাসার দারোয়ান জানান, ২৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতেই একটি গাড়িতে করে পরিবারের সদস্য ও নিজের সহকারী নিশু দে’কে (১৮) নিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার কথা বলে মোহরা ছাড়েন পিয়াল। এই নিশুর মাধ্যমেই টাকার লেনদেন করতেন তিনি। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা একটি ভিডিওতেও ১৫ লাখ টাকার একটি লেনদেনে পিয়ালের সঙ্গে দেখা যায় নিশুকে।

আরও জানা গেছে, ২০২০ সালের করোনাকালীন লকডাউনের সময়ও অর্থকষ্টে দিন কাটতো পিয়ালের পরিবারের। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী তার বাবাও ছিলেন অসুস্থতা। ওই সময় তাকে আর্থিক সহযোগিতা করেছে, এমন মানুষদেরও টাকা নিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু দুই বছর পর রাতারাতি বিজনেস টাইফুন বলে নিজেকে পরিচয় দিতে থাকেন তিনি। রাতারাতি বড় বাসা ভাড়া করেন, গাড়ির মালিকও হয়ে যান তিনি।

কে এই পিয়াল শর্মা

২৫ বছর বয়সী পিয়াল শর্মার পৈতৃক নিবাস রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে। কিন্তু সেই ভিটাবাড়ি বিক্রি করে বহু আগেই পিয়ালের বাবা কাঞ্চন শর্মা চলে আসেন নগরীর পাথরঘাটা এলাকায়। দীর্ঘদিন পাথরঘাটায় ভাড়া বাসায় থাকার পর পিয়ালরা চলে যান চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকায়। ঘটনার আগের দিন পর্যন্ত মা-বোন-স্ত্রীসহ মোহরার এলাকায় থাকতেন তিনি।

পিয়াল আগেও ছিলেন আলোচনায়

২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ভাঙচুর ও সাংবাদিকদের মারার অপরাধে আটক হন পিয়াল শর্মা। এছাড়া পিয়ালের বাবা কাঞ্চন শর্মা পাথরঘাটা থাকা অবস্থায় একটি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির টাকা মেরে বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার কথাও জানান স্থানীয়রা।

বিদেশ পালানোর পূর্ব প্রস্তুতি

বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো পিয়ালের। তাই তিনি ঘটনার কয়েক মাস আগ থেকেই ইউরোপ যাওয়ার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। ফেসবুকে বিদেশ যেতে সহযোগিতা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পেইজে কমেন্ট করে ইউরোপ যাওয়ার বিষয়ে জানতে চান। এছাড়াও নগরীর পাথরঘাটায় একটি ট্রাভেল এজেন্সিতেও এই বিষয়ে কয়েকবার কথা বলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়াও পিয়াল ঘটনার সপ্তাহখানেক আগেই মেয়াদ চলে যাওয়া পুরাতন পাসপোর্ট পাল্টে নতুন ই-পাসপোর্ট করান। এরপর তিনি ভারতের ভিসাও নেন।

দেশ ছেড়ে পলায়ন ২৭ ডিসেম্বর

পিয়ালের কাছে টাকা খাটানো একাধিক ভুক্তভোগীর তথ্যমতে, ২৮ ডিসেম্বর প্রায়ই পার্টনারদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা দেন পিয়াল। সেই হিসেবে একদিন আগে ২৭ ডিসেম্বর জরুরি প্রয়োজনে অল্প কিছু টাকা নেওয়ার জন্য পিয়ালের বাসায় যান এক ভুক্তভোগী। কিন্তু সেদিন নিজেকে খুব অসুস্থ ও কথামতো পরের দিন সব টাকা দিয়ে দেবেন, এমন সান্ত্বনা দিয়ে ওই ভুক্তভোগীকে পাঠিয়ে দেন পিয়াল। মূলত ওইদিন রাতেই পালিয়ে যান তিনি।

ঘটনার বিষয়ে পিয়ালের একাধিক আত্মীয় ও প্রতিবেশী জানান, ২৯ ডিসেম্বর সারাদিন ঘরের দরজায় তালা ছিল। পরে পুলিশে খবর দিলে তারা এসে তালা ভেঙে দেখেন, ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো; ঘরে মূল্যবান জিনিস বলতে শুধু টিভি-ফ্রিজ ও আসবাবপত্রগুলো রয়েছে।

বিশ্বাস অর্জনে দিতেন খালি চেক-স্ট্যাম্প

ধর্মীয় কাজে যুক্ত থাকায় আগে থেকেই পিয়ালকে বিশ্বাস করতো একশ্রেণির হিন্দুরা। তারপরও তিনি জমা নেওয়া টাকার বিপরীতে দিতেন খালি চেক ও স্ট্যাম্প। তবে পিয়ালের দেওয়া সেসব চেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোনো ধরনের টাকা ছিল না। পিয়াল পালিয়ে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা ব্যাংকে গিয়ে দেখেন, পিয়ালের দেওয়া একাধিক ব্যাংকের চেকগুলো ডিসঅনার হয়েছে।

পিয়ালের সর্বশেষ অবস্থান

পিয়ালের অবস্থান নিয়ে সঠিকভাবে কোনো তথ্য না থাকলেও অসমর্থিত কয়েকটি সূত্র বলছে, পিয়াল বৈধভাবে একা ভারতে গিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের বেনাপোল দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করান। আর দেশে আত্মসাত করা টাকা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করেন। তবে ভারতে বাংলাদেশের মানুষদের আনোগোনার বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি সপরিবারে ইউরোপের কোনো দেশে পালানোর চেষ্টায় আছেন। তার তিন মামা স্থায়ীভাবে থাকেন ভারতে। মামাদের সহযোগিতায় পিয়াল হয়তো দ্রুত পালিয়ে যাবেন বলে ধারণা ভুক্তভোগীদের।

আবার আরেকটি সূত্র জানায়, পিয়ালের বাবা এখনও মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েতে চাকরি করেন। ভারত থেকেই পিয়াল সপরিবারে কুয়েত যাওয়ার বিষয়টিও জানান অনেকে। তার ফোন নম্বর বন্ধ থাকলেও হোয়াটসঅ্যাপে তিনি সক্রিয়। মানুষের ম্যাসেজ দেখলেও জবাব দেন না একটিরও।

তবে পিয়ালের বোন ও মাকে নগরীর কোতোয়ালীর ঘাটফরহাদবেগের একটি ভবনে দেখা গেছে বলে দাবি করেন ভুক্তভোগীরা। তবে ভুক্তভোগীরা গেলে ওই ভবনের দারোয়ান তাদের জানান, কিছুক্ষণ আগেই চলে গিয়েছেন ওনারা।

সন্তানের সন্ধান চেয়ে থানায় নিশুর মা ও পিয়ালের শ্বশুর

দেড় বছর আগে থেকে পিয়ালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো নিশু দে। কিন্তু হঠাৎ করে তার সন্ধান না পাওয়ায় অন্ধকার নেমে এসেছে দিনমজুর বাবার পরিবারে। সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে শেষ কথা হয় নিশুর সঙ্গে মা রিংকু দে’র। তিনদিন ধরে খোঁজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে চান্দগাঁও থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে নিশুর পরিবার।

এদিকে মেয়ের সন্ধান চেয়ে থানায় অভিযোগ করতে গেলে সেটি গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান পিয়ালের শ্বশুর শিক্ষক প্রদীপ আচার্য্য। নিজের জামাতার ঘটনায় লজ্জিত তিনি। এমনকি পাওনাদাররা পিয়ালের খোঁজ নিতে শ্বশুরবাড়ি সন্দ্বীপেও গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

পিয়ালকাণ্ডে একাধিক অভিযোগ জমা হয়েছে বলে নিশ্চিত করে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘টাকা আত্মসাতের বিষয়ে থানায় কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে। আরও কয়েকটি জমা হচ্ছে। আমরা তদন্ত করে বিষয়টি দেখছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!