চট্টগ্রামের মানুষ গড়ে ঘুষ দিচ্ছে ৪৯৪৭ টাকা, দুর্নীতির শীর্ষে পাসপোর্ট ও পুলিশ

সেবা নিতে গিয়ে চট্টগ্রামে ৬৭ শতাংশই দুর্নীতির শিকার

চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে ৬৭ শতাংশ সেবাগ্রহীতা বা পরিবার দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। গেল বছরে বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে চট্টগ্রামের প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৪ হাজার ৯৪৭ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে। মোট ১৭টি সেবা খাতে এই ঘুষের টাকা দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এ সময় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলেও চট্টগ্রামে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় আখড়া হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পাসপোর্ট সেবাখাত। চট্টগ্রামের দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৃতীয় স্থানে আছে বিআরটিএ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

টিআইবির প্রতিবেদনে চট্টগ্রামসহ দেশের আটটি বিভাগে মোট ১৭ ধরনের সেবা খাতের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এই দুর্নীতির সময়কাল ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এসব দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে ঘুষ, জোরপূর্বক টাকা আদায়, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন হয়রানি।

সবার ওপরে পাসপোর্ট, নিচে ব্যাংক

টিআইবির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৮৫.১১ শতাংশ মানুষ পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। ৭৭.০১ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থা থেকে সেবা নিতে গিয়ে।

অন্যদিকে চট্টগ্রামে টিআইবির জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৫.৩২ শতাংশ উত্তরদাতা বিআরটিএতে, ৫৭.৯২ শতাংশ উত্তরদাতা বিচারিক সেবায়, ৪৯.১২ শতাংশ উত্তরদাতা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

এছাড়া চট্টগ্রামের ৩৬.৩১ শতাংশ উত্তরদাতা স্বাস্থ্যে, ৩৩.২২ শতাংশ উত্তরদাতা ভূমি সেবায়, ৩৩.১ শতাংশ উত্তরদাতা বিদ্যুত সেবায়, ৩১.২ শতাংশ উত্তরদাতা শিক্ষায়, ২৫.৯২ শতাংশ কৃষিতে, ১৫.৮২ শতাংশ কর ও শুল্কে, ১১.৪১ শতাংশ এনজিওতে, ৯.২২ শতাংশ গ্যাসে, ৮.০২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তায়, ৪.৯১ শতাংশ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে এবং ৭.৭১ শতাংশ অন্যান্য ক্ষেত্রে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।

গড়ে ৪৯৪৭ টাকা ঘুষ

চট্টগ্রামে ২০২১ সালে বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে খানা বা পরিবারকে গড়ে ৪ হাজার ৯৪৭ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে বলে হিসাব দিয়েছে টিআইবি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে গত বছর ৪৬ শতাংশ খানা বা পরিবার ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেন করতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৯ শতাংশ খানা ঘুষ দিয়েছে পাসপোর্ট সেবার জন্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে ৬৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং বিআরটিএ সেবার জন্য ৬৭ দশমিক ৩১ শতাংশ খানা বা পরিবার ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

অন্যদিকে ৪৫.৭০ শতাংশ উত্তরদাতা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে, ৩৩.৩১ শতাংশ উত্তরদাতা বিচারিক সেবায়, ২৮.৯৮ শতাংশ উত্তরদাতা ভূমি সেবায়, ২২.১৩ শতাংশ উত্তরদাতা শিক্ষায়, ১৩.৫৫ শতাংশ কর ও শুল্কে, ১০ শতাংশ উত্তরদাতা বিদ্যুৎ সেবায়, ৭.৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা স্বাস্থ্যে, ৬.২৭ শতাংশ গ্যাসে, ৫.৯২ শতাংশ কৃষিসেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

মানুষ মনে করে, ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই মনে করেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। তারা ঘুষ দেন মূলত হয়রানি বা ঝামেলা এড়াতে।

দুর্নীতির শিকার হলেও তা নিয়ে অভিযোগ করেননি চট্টগ্রামের ৭৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। তাদের বেশিরভাগই অভিযোগের দিকে যাননি মূলত ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে। সবখানেই দুর্নীতি—তাই অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধই করেননি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশগ্রহণকারী। অভিযোগ না করার অন্য সব কারণের মধ্যে রয়েছে—অভিযোগ করে কাজ হয় না, অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা নেই, কিভাবে অভিযোগ করতে হয় জানা নেই। তবে এরপরও যারা অভিযোগ করার পথে হেঁটেছেন, তাদের ৭২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শিকার বেশি পুরুষই, নারীও কাছাকাছি

টিআইবির জরিপে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন পুরুষই বেশি— ৬৭.৫৬ শতাংশ। নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৬২.৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে চট্টগ্রামে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৬৫.১ শতাংশ পুরুষ ও ৮৭.৪ শতাংশ নারী। বিআরটিতে অবশ্য ১০০ শতাংশ পুরুষই দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, নারী ৭৫.৩ শতাংশ। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থা থেকে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৭৬.২ শতাংশ পুরুষ ও ৭৪.৮ শতাংশ নারী। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির কবলে পড়েছেন ৫৬.৯ শতাংশ পুরুষ ও ৫৩.৫ শতাংশ নারী।

ঘুষের ফাঁদে পড়ছেন বয়স্করাই বেশি

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে গেল বছরে ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি (৫০.৩৮ শতাংশ) দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর প্রায় কাছাকাছি রয়েছেন ৪৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সীরা। তবে ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা তুলনামূলক কম (২২.৮১ শতাংশ) দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!