চট্টগ্রামের বিধবা ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়বেন লন্ডন হাইকোর্টে

জয়ী হলে পাবেন ১ কোটি টাকা

খালিদ মোল্লা লেখাপড়া জানতেন না। ২০০৯ সালের শুরুতে তিনি তার গর্ভবতী স্ত্রী হামিদা বেগমকে নিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আসেন। লক্ষ্য ছিল তার, জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ নেওয়া।

দিনে দিনে খালিদ মোল্লা হয়ে ওঠেন জাহাজভাঙ্গা শিল্পের একনিষ্ঠ কর্মী। ২০১৮ সালের মার্চে খালিদ মোল্লার বয়স যখন ৩২ বছর, তখনই আচমকা নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ব্রিটিশ মালিকানা থেকে হাতবদল হয়ে বাংলাদেশে আনা ৩ লাখ টন ওজনের একটি ‘সুপার ট্যাংকার’ শ্রেণির জাহাজ ভাঙ্গা হচ্ছিল সীতাকুণ্ড সৈকতের ঝুমা এন্টারপ্রাইজ শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে। ওই জাহাজের আটতলা সমান উচ্চতা থেকে হঠাৎ পড়ে যান তিনি। মৃত্যু ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই। এই ঘটনায় ট্যাংকারের সাবেক মালিকানা প্রতিষ্ঠান মারান লিমিটেডের অবহেলাকে দায়ী করে তার বিধবা স্ত্রীকে মামলা দায়ের করার অনুমতি দিয়েছে লন্ডন হাইকোর্ট।

ব্রিটিশ কোম্পানি মারানের সাবেক মালিকানায় থাকা ট্যাংকারটির নাম ইকতা। প্রায় দৈত্যাকৃতির জাহাজটির ওজন তিন লাখ টন। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) লন্ডন আদালতের এক বিচারক তার রায়ে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ইকতা ভাঙ্গার সময় যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য মারান ‘অবহেলা’র দায় এড়াতে পারে না। তাই নিহতের বিধবা স্ত্রী হামিদা বেগম এই অভিযোগে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

চলতি বছরের শুরুর দিকে খালিদ মোল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছিল প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। এরপর যুক্তরাজ্যের আইনি অধিকার ও পরামর্শক সংস্থা লেইহ ডের সাহায্যে হামিদা বেগম ব্রিটিশ আদালতে মামলার জন্য আপিল করেন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মারান লিমিটেডের মূল মালিকানা গ্রিসের আঞ্জেইকোসুইস শিপিং গ্রুপের। বেসরকারি মালিকানায় থাকা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জাহাজ বহর রয়েছে তাদের। দুটি প্রতিষ্ঠানের কেউই খালিদ মোল্লাহর নিয়োগদাতা নয়। তবে পুরোনো জাহাজটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য অধিক মুনাফার লোভে তারা জাহাজটি বাংলাদেশে আসার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেন ব্রিটিশ আদালত।

আদালত বাংলাদেশের জাহাজভাঙ্গা শিল্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছরই বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছেন শত শত চুক্তিহীন শ্রমিক। ইকতাকে এমন পরিবেশে ভাঙ্গার মাধ্যমে শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন হবে, একথা জানার পরও জাহাজটির সাবেক মালিকপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তা যথাযথ নয়।

লন্ডন উচ্চ আদালতের বিচারক রবার্ট জে আইনি সংস্থা লেইহ ডে’র উপস্থাপিত যুক্তির সঙ্গেও একমত পোষণ করেন। লেইহ ডে তাদের আর্জিতে উল্লেখ করে, বিক্রির পর জাহাজ কোথায় ভাঙ্গা হবে; তা নির্ধারণের ক্ষমতা মারান লিমিটেডের ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বৈধ পন্থায় জাহাজটির ভাঙ্গা নিশ্চিত করলে, তারা এর জন্য কম দাম পেত। তাই মুনাফার লোভেই তারা জাহাজটিকে দক্ষিণ এশিয়ার অরক্ষিত শিল্পের হাতে তুলে দিয়েছে।

উচ্চ আদালতের রায়ের পর এখন ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানি মারানের বিরুদ্ধে সরাসরি অবহেলার দায়ে মামলা করতে আর কোনও বাধা থাকল না। সেই মামলায় জয়ী হলে হামিদা বেগম সর্বোচ্চ এক লাখ পাউন্ড (বাংলাদেশি মূদ্রায় প্রায় এক কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।

দুর্ঘটনার প্রায় এক বছর পর হামিদা বেগমকে চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরে একাকী নারী হিসাবে তাকে এমনকি কেউ ঘরভাড়াও দিচ্ছিল না। তাছাড়া তিনি নিজেও অনিরাপদ বোধ করছিলেন। তিনি স্বামীর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার ও ইয়ার্ড থেকে পাওয়া প্রায় ৬ লাখ টাকার বেশিরভাগই তার ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলেন, যার বিনিময়ে তিনি ও তার ছেলের ভরণপোষণ ও আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন ওই ভাইটি।

যদিও এই মামলার গুরুত্ব অন্যখানে। এর ফলে বাংলাদেশের শত শত নিহত শ্রমিকের পরিবার এখন ইউরোপীয় মালিকানাধীন অন্যান্য পুরোনো জাহাজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ পাবেন। ফলে বাধ্য হয়েই শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাধ্য হতে হবে দেশের শিপইয়ার্ডগুলোর মালিকপক্ষকে।

আইনি প্রতিষ্ঠান লেইহ ডে’র একজন অংশীদার অলিভার হল্যান্ড বলেন, ‘আদালতের রায়ে আমাদের মক্কেল হালিমা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। দুর্ঘটনায় তিনি শুধু তার স্বামীকে হারাননি বরং তার সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবিকাও হারিয়েছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘মারান লিমিটেড যদি হালিমা বেগমের স্বামীর মৃত্যুর মামলায় হেরে যায়; তবে এরপর থেকে যুক্তরাজ্যের অন্যান্য জাহাজ মালিকেরাও সতর্ক থাকবে। মুনাফার লোভে দক্ষিণ এশীয় শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন করার আগেও তারা দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবে।’

এ রায়ের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য মারান লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। কিন্তু কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

সিপি

উৎস: দ্য গার্ডিয়ান

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!