চট্টগ্রামের ‘বদ্দা’ দেশে গার্মেন্টসপণ্য চুরির মাস্টারমাইন্ড, চক্রে ৫০ জনের জোট

চুরি ঠেকাতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়কে বসছে ক্যামেরা

ব্রাজিলে নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কাভার্ড ভ্যানে করে পোশাকের একটি চালান পাঠানো হয় গাজীপুরের একটি কারখানা থেকে। পরদিন ৮৯৮ কার্টনভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে ঠিকমতোই পৌঁছায়। সংশ্লিষ্ট শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায়। চালানবহনকারী জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রওনা দেওয়ার পরপরই ব্রাজিলের ক্রেতা পুরো অর্থও পরিশোধ করে দেন। কিন্তু ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান গাজীপুরের সেই গার্মেন্টস কারখানার মালিক। ব্রাজিল থেকে পাঠানো সেই ভিডিওতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যাওয়া কিছু কার্টন পুরোপুরি খালি। অনেক কার্টনের ভেতর আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যও নেই। শেষ পর্যন্ত চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় গাজীপুরের সেই মালিককে।

এভাবে বিদেশে পাঠানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পথে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে রীতিমতো দেশের রপ্তানি আয়ই কমিয়ে দিচ্ছিল সংঘবদ্ধ একাধিক চোরচক্র। এতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। আবার বাংলাদেশে এই দুরবস্থা দেখে বিদেশি ক্রেতাদের অনেকে বিকল্প বাজার খুঁজছেন অন্য দেশে।

সম্প্রতি র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে এসেছে, সংঘবদ্ধ চোরচক্রগুলোর মূল হোতা চট্টগ্রামের এক ‘বদ্দা’। তাকে কেউ শাহেদ, কেউ বা আবার সাঈদ নামে চিনলেও ‘বদ্দা’ নামে তাকে সবাই চেনে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই গার্মেন্টস পণ্য চুরিজগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের মূল হোতা ও নির্দেশদাতা। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে গার্মেন্টস পণ্য চুরির অধিকাংশ ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গামেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত এই সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা কৌশল হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টসের মালামাল বহন শুরু করে। একপর্যায়ে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। অল্প সময়ে বেশি টাকা লাভের লোভ দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনা ঘটানোর আগে ড্রাইভারদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করা গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করতো।

ব্রাজিলে রপ্তানি করা সেই গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদ ওরফে বদ্দার নির্দেশেই ঘটে। জানা গেছে, গত বছরের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ড ভ্যানে লোড করে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কাভার্ড ভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ড্রাইভার শাহজাহানের কাছে স্যাম্পল হিসেবে কিছু সোয়েটার দিয়ে রাখে। ড্রাইভার শাহজাহান সেই স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূল হোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ স্যাম্পল পেয়ে চোরচক্রের সদস্য তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠান। এরপর পণ্যের গুণগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে চালানটিতে চুরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে আবার প্যাকেজিংয়ের পর চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চালানটি।

চুরির ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র‌্যাব। ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে র‌্যাব-৪ এর পৃথক পৃথক অভিযানে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে আলোচিত ব্রাজিলে রপ্তানির গার্মেন্টস পণ্য ছাড়াও প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্টস পণ্যসহ সংঘবদ্ধ চোরচক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

মূল হোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২) ছাড়াও গ্রেপ্তাররা হলেন— ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০) ও মো. হৃদয় (২৮)। এ সময় উদ্ধার করা হয় ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্যের পরিবহনে ব্যবহৃত একটি কাভার্ড ভ্যান।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গ্রেফতার শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের মূল হোতা ও নির্দেশদাতা। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার।’

তিনি জানান, ‘গ্রেপ্তার শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ২টি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যবসা শুরু করে এবং ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪টি কাভার্ড ভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে। সে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার এবং হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোরচক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিজেই উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যায়। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ পেত মূল হোতা শাহেদ। চুরি করা ২০ কোটি টাকায় সে বাড়ি ও মাছের খামার নির্মাণ করেছে।’

জানা গেছে, শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা গত দেড় যুগ ধরেই গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছেন। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানির সময় প্রায় দুই হাজারের বেশি কাভার্ডভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত। আর এই চুরির ঘটনায় অর্জিত অর্থ দিয়ে শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা মৌলভীবাজার শহরে প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি তৈরি করেছেন। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির ওপরে মাছের খামারসহ হাঁস-মুরগির বিশাল দুটি খামারও রয়েছে তার। বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি কাভার্ড ভ্যানসহ তার সহযোগীর আরও ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে।

তথ্য পাওয়া গেছে, শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে। অধিকাংশ মামলায় তিনি কারাভোগ করেছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ৬টি মামলার বিচারকার্য চলমান।

মহাসড়কে চুরি ঠেকাতে ‘ভিডিও সার্ভিলেন্স’

এদিকে রপ্তানিমুখী পণ্য পরিবহন নিরাপদ করতে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোকে ভিডিও সার্ভিলেন্সের আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগ সফল হলে পণ্য পরিবহন ছাড়াও মহাসড়কে ডাকাতি, চুরিসহ অন্যান্য অপরাধও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেইট পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার জুড়ে ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। যা নিয়ন্ত্রিত হবে মেঘনা ঘাটে স্থাপিত হাইওয়ে পুলিশের কমান্ড ও মনিটরিং সেন্টার থেকে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫২ শতাংশ শেষ হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের হিসাবে, প্রতিবছর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য চুরি ও ডাকাতির শিকার হচ্ছে। এছাড়াও মহাসড়কে জান-মাল নিরাপদ রাখতে নানামুখী কার্যক্রম শুরু করেছে হাইওয়ে পুলিশ। আর রাজধানীর নিকটবর্তী সাইনবোর্ড এলাকা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেইট পর্যন্ত ক্যামেরা বসানো হলে এ মহাসড়ক পুলিশের পুরো নজরদারির মধ্যে চলে আসবে। ২৫০ কিলোমিটারে ৪৫০টি ক্যামেরা পুলে প্রায় দেড় হাজার ক্যামেরা বসানো হবে। ফেনী পর্যন্ত মাটির নিচে অপটিক্যাল ফাইবার বসানো হয়েছে। মার্চে সাইনবোর্ড থেকে দাউদকান্দি ও আগামী জুনের মধ্যে সবগুলো ক্যামেরা চালু করার চেষ্টা চলছে। এ জন্য সরকারের খরচ হবে ১২৯ কোটি টাকা। এছাড়াও এটা পরিচালনায় প্রতি মাসে খরচ হবে প্রায় ১ কোটি টাকা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!