চট্টগ্রামের প্রাইভেট ক্লিনিকে অস্বাভাবিক সিজারিয়ান, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উল্টো চিত্র

সিজারিয়ান অপারেশনে সন্তান জন্মদান অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণে হচ্ছে চট্টগ্রামের প্রাইভেট ক্লিনিক ও এনজিও পরিচালিত মাতৃসদনগুলোতেই। অথচ ১৪ উপজেলার সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এই চিত্র পুরোপুরি উল্টো। সেখানে ‘নরমাল ডেলিভারি’র হার সবচেয়ে বেশি। শুধুমাত্র গত জুলাইয়ে চট্টগ্রামের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে মোট ১ হাজার ২৮টি ডেলিভারির ৫৮০টিই সিজারিয়ান। এনজিও পরিচালিত ১০টি মাতৃসদন কেন্দ্রে মোট ১ হাজার ২৭৩টি ডেলিভারির ৪৫৯টিই সিজারিয়ান। অথচ চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৮৯৫টি ডেলিভারির মধ্যে সিজারিয়ান মাত্র ৯টি আর নরমাল ডেলিভারি ৮৮৬টি।

চট্টগ্রামের গাইনি ডাক্তাররাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, এই করোনার সময়েও প্রাইভেট ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের সিজারিয়ানেই উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং এটা প্রতিনিয়তই হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম জেলায় করোনাকালে গর্ভবতী নারীরা নরমাল ডেলিভারিতে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গর্ভবতী মায়েরাও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে গর্ভকালীন সেবা নিচ্ছেন। সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ও চিকিৎসকরা Parturition chart বা পার্টোগ্রাফ মেনে রোগীকে লেবার রুমে শেষ পর্যন্ত কাউন্সেলিং করে যাচ্ছেন। এভাবে গর্ভবতী নারীদের প্রায় সকলেই স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্মদানে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু একই সময়ে প্রাইভেট ক্লিনিক ও এনজিও পরিচালিত মাতৃসদনে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। সিজারিয়ান অপারেশনে সন্তান জন্মদানের হার সেখানে অস্বাভাবিক বেশি— যার সংখ্যা প্রায় নরমাল ডেলিভারি মতোই।

সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কেন নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বেশি— এই বিষয়টির নেপথ্য কারণ জানাতে গিয়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নাবিল চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতি সেবা ইউনিট আছে। সেখানে গর্ভধারণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন গর্ভবতী নারী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ও ডাক্তাররা রোগীদের চিকিৎসা সেবা ও কাউন্সেলিং করে থাকেন। পরবর্তীতে যখন সেই গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসবের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন, তখন তার জন্য একটি Parturition chart বা পার্টোগ্রাফ করা হয়। এটি নরমাল ডেলিভারিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।

বিষয়টি ব্যাখা করে ডা. নাবিল আরও বলেন, এই গ্রাফে দুটি লাইন থাকে— অ্যাকশন লাইন ও অ্যালার্ট লাইন। সময়ের সাথে সাথে লেবার টেবিলে থাকা গর্ভবতী মায়ের অবস্থা দেখে গ্রাফের অগ্রগতি-অবনতি নির্ধারিত হয়। আর এটা দেখে বোঝা যায়, প্রসব প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক। যদি স্বাভাবিকের দিকে থাকে, তাহলে অপেক্ষা করা হয় নরমাল ডেলিভারির জন্য। আর যদি অস্বাভাবিকের দিকে থাকে, তাহলে সিজারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তবে এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের কথাও জানান ডা. নাবিল। তিনি বলেন, করোনাকালীন গর্ভবতী যেসব নারীর মধ্যে করোনার লক্ষণ ছিল, তাদের কাছ থেকে করোনা লক্ষণমুক্ত মায়েদের আলাদা করে রাখা হয়। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ফ্লু কর্নার আছে। কিন্তু সমস্যা যেটা তৈরি হয়, সেটি হল— রোগীরা করোনার চিকিৎসার পাশাপাশি গর্ভকালীন সেবাও নিতে আসতে চান না। করোনার কথা গোপন রাখার একটা প্রবণতা দেখা যায়। খবর পেলে আমরা ফোন করে এ ধরনের রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে উদ্ধুদ্ধ করে থাকি। আবার করোনার ভয়ে সন্তান প্রসবের পরে প্রসবপরবর্তী সেবা নিতেও প্রসূতি মেয়েদের মধ্যে আগ্রহ কম দেখা যায়। তাদেরও আমরা ফোন করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। তবে এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে বদলেছে। গর্ভবতী মায়েরা স্বেচ্ছায় আগের মতোই প্রসবপূর্ব ও প্রসবের সময় ছাড়াও প্রসবোত্তর সেবা নিতে হাসপাতালে আসছেন।
 
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন অফিস থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, চট্টগ্রাম জেলায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করেছেন ৬ হাজার ১৪৫ জন গর্ভবতী নারী।

শুধুমাত্র চলতি বছরের জুলাইয়ে জেলাসহ এনজিও পরিচালিত ১০টি মাতৃসদন ও প্রাইভেট ক্লিনিকে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ১২ হাজার ৫৭৩ জন নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৬৪৪ জন। তাদের মধ্যে আবার গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ৪৭০ জনের মধ্যে। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ৩ হাজার ১৯৬ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ২ হাজার ১৩৮ জনের এবং সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়েছে ১ হাজার ৪৮ জন গর্ভবতী নারীর।

জুলাই মাসের এই হিসাব থেকে প্রাইভেট ক্লিনিককে আলাদা করলে দেখা যায়, সেখানে ৩ হাজার ২৩৮ জন নারী গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ডেলিভারির সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৩৭ জন। এর মধ্যে গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ২৮১ জনের। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ১ হাজার ২৮ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৪৪২ জনের এবং সিজারিয়ান হয়েছে ৫৮০ জনের।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের আওতাধীন এনজিও পরিচালিত ১০টি মাতৃসদন কেন্দ্রে সেবাদানের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শুধুমাত্র গত জুলাই মাসে সেখানে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ২৬৭ জন গর্ভবতী নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ২১৯ জন। তাদের মধ্যে গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ১০৯ জনের। সবমিলিয়ে ডেলিভারি হয়েছে ১ হাজার ২৭৩ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৮১০ জনের এবং সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে ৪৫৯ জনের।

এদিকে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পটিয়ার পাঁচুরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এই ১৫টি সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ৩ হাজার ৬৮ জন। এর মধ্যে সন্তান জন্মদানের আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৪৪ জন। তাদের গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ৪০ জনের মধ্যে। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ৮৯৫ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৮৮৬ জন নারীর। আর সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে ৯ জনের।

অন্যদিকে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় এই সময়ে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ৭১ হাজার ৪৯৪ জন নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ১৯১ জন। তাদের মধ্যে আবার গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ৩ হাজার ৫৪ জনের মধ্যে। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ২১ হাজার ২৩৬ জন নারীর। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ১৪ হাজার ৮১৪ জন নারীর এবং সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে ৬ হাজার ২২২ জনের।

এই ছয় মাসে শুধু প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ১২ হাজার ৬৪ জন নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৪৫ জন। গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ১ হাজার ৪৫৫ জনের। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ৫ হাজার ৬০৯ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি ২ হাজার ৭০৭ জনের এবং সিজারিয়ান হয়েছে ২ হাজার ৮২৫ জনের।

অন্যদিকে এই একই সময়ে এনজিও পরিচালিত মাতৃসদনে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ৪০ হাজার ৫১৭ জন নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৫৭২জন। গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ৮৪২ জনের। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ৮ হাজার ৬০৪ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৫ হাজার ২০২ জনের এবং সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে ৩ হাজার ৩২৭ জনের।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শাহেনা আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সিজারিয়ানে ইনডেকেশনস না থাকলে কখনোই সিজার করা হয় না। যখন মায়ের পেটের মধ্যে বাচ্চার অবস্থানে অস্বাভাবিকতা ও লেবার পেইন দীর্ঘ সময় পরও ওঠে না, তখনই ডাক্তার সিজারিয়ানের সিদ্ধান্ত নেন। তবে উচ্চবিত্ত নারীরা অনেক ক্ষেত্রে লেবার পেইন সহ্য করতে চান না। তখন চিকিৎসক হবু মায়ের সিদ্ধান্তেই সিজারিয়ানে যান।

তিনি বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান কম। তার কারণ হল জটিল রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে দেওয়া হয়।

কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গাইনি বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, এই করোনার সময়েও প্রাইভেট ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের সিজারিয়ানেই উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এটা প্রতিনিয়তই হয়ে থাকে। আর প্রসূতি মায়েদের প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং ও সহযোগিতা না করায় রোগীদের লেবার পেইনও যথাযথভাবে ওঠে না।

মূলত সন্তান জন্মদানের সময়ে Parturition chart বা পার্টোগ্রাফ অনুসরণ করা না করায় অহেতুক সিজারিয়ান অপারেশনে সন্তান জন্মদানের হার বাড়ছে বলে অভিমত ওই চিকিৎসকদের।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!