চট্টগ্রামের নতুন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, ছাত্রলীগের কর্মী থেকে নগরপিতা

ঠিক একবছর আগে, গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গভবনে যখন চলছিল মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক, তখন রেজাউল করিম চৌধুরী সেখানে হাঁটছিলেন একা একা। তার পাশে ছিল না নেতাকর্মীদের জটলা। রাতেই এক ঝটকায় বদলে গেল সেই দৃশ্যপট। শেষ পর্যন্ত সবাইকে চমকে দিয়ে আওয়ামী লীগ আস্থা রাখল দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতা নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীর ওপর। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনিই হয়ে গেলেন নৌকার মাঝি।

ঠিক একবছর পর, বুধবার (২৭ জানুয়ারি) নিভৃতচারী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত রেজাউল করিম চৌধুরী নিজে মাঝি হয়ে নৌকাকে ভেড়ালেন সাফল্যের ঘাটে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে মেয়র হিসেবে বিজয়ী হলেন তিনি।

বুধবার (২৭ জানুয়ারি) দিবাগত রাত দেড়টায় চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামে স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মেয়র পদে ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়।

এতে বিজয়ী রেজাউল করিম চৌধুরী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৮৪ ভোট। অন্যদিকে বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪২৯ ভোট। রেজাউল ও শাহাদাতের ভোটের ব্যবধান তিন লাখ ১৬ হাজার ৮৫৫। ভোটগ্রহণের হার অবশ্য ২২ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন এবং নারী ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন।

মেয়র পদে থাকা অন্য প্রার্থীদের মধ্যে মোমবাতি প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মতিন পেয়েছেন ২ হাজার ১২৬ ভোট, আম প্রতীক নিয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আবুল মনজুর পেয়েছেন ৪ হাজার ৬৫৩ ভোট, হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৮০ ভোট, চেয়ার প্রতীক নিয়ে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ পেয়েছেন ১ হাজার ১০৯ ভোট ও হাতি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে খোকন চৌধুরী পেয়েছেন ৮৮৫ ভোট।

রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও এনামুল হক দানুর কমিটিতে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায়ের সাথে জড়িত।

রেজাউল করিম চৌধুরীর পিতা মরহুম হারুন-অর-রশীদ চৌধুরী ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তার দাদা ছালেহ আহমদ ছিলেন ইংরেজশাসিত ভারত এবং পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ও চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত বিলুপ্ত কমরেড ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরিবারের বড় ভাই অধ্যাপক সুলতানুল আলম চৌধুরী ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তার পূর্ব পুরুষেরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ২৩টি মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ অসংখ্য জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। যার কারণে এলাকার জনসাধারণ এখনও শ্রদ্ধা ভরে খ্যাতিমান ঐতিহ্যবাহী বহদ্দার পরিবারের কথা।

১৯৫৩ সালের ৩১ মে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার অন্তর্গত ৬নং পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের ঐতিহ্যবাহী। প্রাচীন জমিদার বংশ বহদ্দার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

সাবেক বৃহত্তর পাঁচলাইশ থানায় রেজাউল করিম পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা এলাকায় শিক্ষার প্রসারের জন্যে ১৮২০ সালে বহদ্দার হাটে নিজস্ব জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব ষোলশহর প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে ৫ম শ্রেণী এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তারপর আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্যে ভর্তি হন। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর হত্যার প্রতিবাদে সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ লড়াইয়ে নেমে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেননি।

রেজাউল করিম চৌধুরী ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭০ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছরেই ১৯৭২ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য হন ১৯৭০ সালে। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭৬ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৮ সালে আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

১৯৮০ সালে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন রেজাউল। ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

রেজাউল করিম চট্টগ্রামের উন্নয়নের দাবিতে সর্বপ্রথম সংগঠন চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ ও চট্টগ্রামের দুঃখ নামে খ্যাত চাক্তাই খাল খনন সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৮৩৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিজয় মেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক। চট্টগ্রাম বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব ছিলেন ২০১১ সালে এবং ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন ২০১৪ সালে।

চান্দগাঁও এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়, বদর শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটি ও পূর্ব ষোলশহর ওয়াছিয়া আহমদিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।

রেজাউল করিমের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে জামায়াত শিবিরের হিংস্রতা ও ধর্মীয় রাজনীতি (১৯৯৩), কালো টাকানির্ভর রুগ্ন রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে হবে (২০১৪), ছাত্রলীগ ষাটের দশকে চট্টগ্রাম (২০১৬) এবং স্বদেশের রাজনীতি ও ঘরের শত্র বিভীষন (২০১৯)।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক পুত্রের জনক। স্ত্রী সেলিনা আক্তার গৃহিণী, মেয়ে তানজিনা শারমিন নিপুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আরেক কন্যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ছোট ছেলে ইমরান রেজা চৌধুরী কেমিক্যাল প্রকৌশল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!