চট্টগ্রামের থানায় থানায় সোর্সদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ, অপরাধে পুলিশই সহযোগী

চট্টগ্রাম নগরে পুলিশের কথিত সোর্সরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে ক্রমেই। তাদের বেশিরভাগ অপরাধই ধামাচাপা দেওয়া হলেও ইদানিংকালে বেরিয়ে আসছে একের পর এক অপরাধের কাহিনী। চট্টগ্রামের পুলিশের অধিকাংশ সোর্সই সাধারণত পেশাদার অপরাধী। নামে ‘পুলিশের সোর্স’ হলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নিরীহ লোকজনকে ফাসিয়ে অর্থ আদায়, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধই কথিত এই সোর্সদের মূল কাজ।

সাম্প্রতিক সময়ে শুধু চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকায় তিনটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পুলিশ সোর্সদের সরাসরি জড়িত থাকার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয় পুরো নগরজুড়েই। সদরঘাট, চকবাজার, চান্দগাঁও থানাসহ নগরীর আরও বেশ কয়েকটি থানায় এই সোর্সদের দৌরাত্ম্যে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রামে নানা ঘটনায় প্রায়ই আলোচনায় আসছে পুলিশের সোর্স বা অনুচররা। মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেন, পুলিশের সোর্সরা প্রায়ই নিজ স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সোর্সদের ওপর এতো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই না করেই অভিযান চালায়— যাতে অনেক নিরীহ মানুষ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়।

গত রোববার (২৭ সেপ্টেম্বর) বোনের বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়ে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং এলাকার সুপারিওয়ালাপাড়ায় এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। যাদের মধ্যে প্রধান আসামি চান্দু মিয়া ‘পুলিশের সোর্স’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। এই পরিচয় ভাঙিয়ে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, নিরীহ লোকজনকে ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়, নারীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ইতিমধ্যে চান্দু কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, এলাকায় রীতিমতো ত্রাস ছিল চান্দু। তার অত্যাচার ও অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হলেও ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতেন না। কারণ তার ওপরে আশীর্বাদ ছিল ডবলমুরিং থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যের। আবার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবও খাটাতো চান্দু। ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের বিতর্কিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদের আপন চাচাতো ভাই এই চান্দু মিয়া। চান্দু তার সহযোগীদের নিয়ে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক মিছিলেও অংশ নিতো বলে জানা গেছে স্থানীয় সূত্রে।

এদিকে একই থানা এলাকায় গত ৪ সেপ্টেম্বর ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আইয়ুব আলী নামে এক ড্রাইভার। তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন। ঘটনার দিন রিক্সাযোগে লালখান বাজার থেকে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বারিক বিল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে প্রকাশ্য সড়কে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় আটক হয় পাঁচজন। এদের মধ্যে বাবু নামে এক আসামি সদরঘাট থানা পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

কথিত এই সোর্সের বিরুদ্ধে মানুষের গাড়ি-অফিসে বা ঘরে মাদক রেখে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানোর অভিযোগ রয়েছে। পরে নগদ টাকায় রফাদফা করা হতো থানায়। পুলিশের অভিযানে উদ্ধার করা মাদকদ্রব্য আবার এই ‘সোর্স’ বাবুর মাধ্যমে বিক্রি করা হতো— এমন অভিযোগের কথাও জানা গেছে একাধিক সূত্রে। সম্প্রতি মাদারবাড়ি এলাকায় মুন্না নামের এক গাড়িচালকের মোবাইল ছিনিয়ে নেয় বাবু। এরপর তাকে এলাকাবাসী ধরে মারধর করার পর সেই মোবাইল উদ্ধার হয়। কিন্তু এরপর থেকে উল্টো ঘটনার শিকার মুন্নাকে সদরঘাট থানার এসআই মাহতাবের হয়রানিতে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় বেশ অনেকদিন।

জানা গেছে, আগ্রাবাদে ড্রাইভার আয়ুব আলী হত্যাকাণ্ডে সোর্স বাবুর নাম আলোচনায় উঠে আসার পর সদরঘাট থানা পুলিশ গাড়িচালক মুন্নাকে হয়রানি করা বন্ধ করে। কিন্তু এরপরও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মুন্না ও তার পরিবার। ‘সোর্স’ বাবু এর আগেও মুন্নার গাড়িতে মাদকদ্রব্য রেখে তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছিল। ওই সময় থানাকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ঘরে ফেরেন কিশোর মুন্না। সদরঘাট থানার এসআই মাহতাব, গৌতম ও মোর্শেদের হয়ে এসব অপকর্মে জড়িত ছিল ‘সোর্স’ বাবু। এর মধ্যে এসআই মোর্শেদ কিছুদিন আগে বিতর্কিত ১২ জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বদলি হয়ে যান সদরঘাট থানা থেকে।

এর আগে গত জুলাই মাসে সাদা পোশাকে পুলিশের অভিযানের পর এক কিশোরকে মৃত্যুর ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা করে পুলিশ। এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কথিত দুই সোর্সকে সঙ্গে নিয়ে ডবলমুরিং থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বাদামতলীর বড় মসজিদ গলিতে একটি বাসায় অভিযানে যান। দুই সোর্সের সঙ্গে মিলে মারুফ নামে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে তারা প্রচণ্ড মারধর করে। একপর্যায়ে তার কাছ থেকে টাকা দাবি করে পুলিশ। পরে তাকে আটকের চেষ্টাও করা হয়। তখন তার পরিবারের সদস্যরা বাধা দিলে ধস্তাধস্তিতে ওই কিশোরের মা ও বোন আহত হন। পরে পুলিশ তাদের হাসপাতালে নিয়ে গেলেও রাতে নিজ বাসা থেকেই মারুফের ‘ঝুলন্ত লাশ’ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ওই অভিযানের বিষয়ে সুস্পষ্ট কারণও দেখাতে পারেনি। স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে সাদা পোশাকে অভিযানে যাওয়া এসআই হেলাল উদ্দিনকে পরে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। জানা গেছে, এ ঘটনায় এসআই হেলালের সঙ্গে যাওয়া দুই সোর্সের মধ্যে সুপারিওয়ালা পাড়ায় কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় আটক চান্দু মিয়াও ছিল সেদিন।

এদিকে নগরীর চকবাজার থানা পুলিশের কথিত দুই সোর্সের বিরুদ্ধেও রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। আলোচিত এই দুই সোর্স হচ্ছে— নাছির উদ্দিন ওরফে ল্যাডা নাছির ও সেকান্দর। নাছির একসময় শিবিরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছিল। ফটিকছড়িতে নিজের মাকে হত্যাসহ একাধিক মামলায় অভিযুক্ত নাছির বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ছিল চকবাজার এলাকার ত্রাস। পুলিশের করা শিবির ক্যাডারদের তালিকায় প্রথমেই তার নাম থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ ‘পুলিশের সোর্স’ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে নাছিরের। মূলত গ্রেফতার এড়াতেই সোর্স হিসেবে কাজ করছে নাছির— এমন তথ্য জানিয়েছে চকবাজার থানার একটি সূত্র।

তবে ক্ষমতার বদল হলেও, এমনকি অপরাধের ধরন বদলে গেলেও বন্ধ হয়নি নাছির ও সেকান্দরের অপকর্ম। পুলিশের সহায়তায় নিরীহ লোকজনকে ফাসিয়ে অর্থ আদায়, মাদক ও জুয়ার স্পটগুলো থেকে পুলিশের নামে মাসোহারা আদায় করে যাচ্ছে কথিত এই দুই সোর্স। থানায় আসা ভুক্তভোগীদের থেকেও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। চকবাজার এলাকায় তাদের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্র সক্রিয়। তারা এমনই বেপরোয়া যে, এমনকি থানা ফটকের ভেতর ও বাইরে ইয়াবাও বিক্রি করে কথিত দুই সোর্স নাছির ও সেকান্দর।

পুলিশের সোর্স নাছিরের আবার একটি টোকাই বাহিনী আছে। এদের কাজই হল ছিনতাই করা। চকবাজার থানার ওসি (তদন্ত) রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী এই নাছিরের মূল আশ্রয়দাতা। রাতে তিনি থানাতেই পড়ে থাকেন। প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে বাইকে তাকে চলাফেরা করতে দেখা যায়। বুধবারও (৩০ সেপ্টেম্বর) নাছিরকে চকবাজার থানার এএসআই আরেফিনের সঙ্গে তার বাইকে দেখা গেছে বলে স্থানীয়রা জানান। অথচ এই নাছিরের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, অস্ত্র, বিস্ফোরক ছাড়াও আরও কিছু মামলা।

জানা গেছে, সেকান্দরের বিরুদ্ধে তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ চান্দগাঁও থানা এলাকায় গিয়ে এক বিউটিশিয়ানকে তুলে নিয়ে ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে গত জানুয়ারি মাসে। তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ওই বিউটিশিয়ান পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার এ ঘটনায় পুলিশের দুই এসআইকে ক্লোজ করা হয়। উর্ধতন কর্মকর্তাদের চাপের মুখে ওই বিউটিশিয়ানের টাকাও ফেরত দেয় তারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেকান্দর চান্দগাঁও ও চকবাজার এলাকার পেশাদার অপরাধী। চকবাজার থানার গাসিয়া পাড়া এলাকায় তার ভাই মিন্টু একটি মাদকস্পট পরিচালনা করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত নয়টার দিকে চকবাজার থানার পুলিশ ক্যান্টিনে দেখা গেছে সেকান্দর ও নাছির নামের এই দুই সোর্সকে। তাদের সঙ্গে এক পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন।

চকবাজারের পুলিশের আরেক সোর্স আক্কাস। চকবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশের পক্ষ হয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করাই তার মূল কাজ। এর বাইরে নিরীহ মানুষকে মাদক দিয়ে ধরিয়ে সাজানো গ্রেপ্তারের বাণিজ্যেও তাকে প্রায়ই দেখা যায়। কয়েক বছর আগে চকবাজারের ক্ষুব্ধ মানুষ কথিত এই সোর্স আক্কাসের কান কেটে দেয়। সেই থেকে তাকে ‘কানকাটা আক্কাস’ হিসেবেই স্থানীয়ভাবে সবাই চেনে।

চকবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আক্কাস মূলত র‌্যাব ও পুলিশের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন। এক সময় চকসুপার মার্কেটে তিনি ভিডিও-সিডির দোকানে কাজ করতেন। সেই আক্কাস এখন পুলিশের সোর্স। চকবাজার জামে মসজিদের বিপরীতে চক সুপার মার্কেটের পশ্চিম দিকের কোণায় একটা জায়গা দখল করে রাস্তার ওপর তার একটি দোকান তৈরি করেছেন। ইজারাদাররা সেটা তুলে দিলেও চকবাজার থানার পুলিশ আবার তাকে সেখানে বসিয়েছে। আক্কাস ওই দোকান এক লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। বাজারের ভেতর তার একটা ‘অফিস’ও আছে, যেখানে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সোর্স আক্কাসের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ নেন না চকবাজার থানার ওসি রুহুল আমিন। উল্টো কিছুদিন আগে আক্কাসের করা কথিত অভিযোগে ইজারাদারদের থানায় ডেকেছিলেন ওসি।

এদিকে বহদ্দারহাট এলাকার দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী ও সবুর হত্যা মামলার প্রধান আসামি ইমন বড়ুয়ার বাবা রঞ্জিত বড়ুয়া পুলিশের সোর্স হিসেবে নানা অপকর্মে জড়িত। ফুটপাতের দোকান, গাড়ি স্ট্যান্ড, মাদক কারবারি, জুয়ার আসর থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাত থেকে পুলিশের নামে মাসোহারা আদায় করার দায়িত্বে আছে কথিত সোর্স রঞ্জিত বড়ুয়া। বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের ইনচার্জ বিতর্কিত এসআই রূপক কান্তি চৌধুরীর অধীনে সোর্স হিসেবে তিনি কাজ করে থাকেন।

চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে মিলে ইয়াবাসহ মাদক দিয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগও কম নয়। গত বছরের ১৫ মে জহিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর জানা যায়, ওই লোক পুলিশের কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেন অন্য সংস্থার সোর্স হিসেবে এবং অন্য সংস্থার কাছে পরিচয় দিতেন পুলিশের সোর্স হিসেবে। এর আড়ালে লোকটি মূলত বিক্রি করতেন ইয়াবা।

এভাবে চট্টগ্রাম নগরীর প্রতিটি থানায় অধিকাংশ সোর্স পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে— যাদের প্রায় সবাই পেশাদার অপরাধী। পুলিশের সাথে সখ্য থাকায় নানা অপরাধে জড়িয়েও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!