চট্টগ্রামের জুবায়েরের দেওয়া তথ্যে ঢাকায় খুন হন দুই সমকামী অধিকারকর্মী

গোয়েন্দাগিরি করতে নিজে সমকামীও সাজেন

ছয় বছর আগে সমকামীসহ চার ধরনের লোককে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জুবায়ের। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) নীতিনির্ধারণী শুরা কমিটির এই সদস্য নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবিটির সদস্যদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের মধ্যস্থতাও করতেন বলে পুলিশের দাবি।

ঢাকায় সমকামী অধিকার নিয়ে কাজ করা আমেরিকান সংস্থার কর্মকর্তাকে খুনের আগে নিপুণ কৌশলে তার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলেন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ছাত্র মো. জুবায়ের। আইআইইউসির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র জুবায়েরের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে বাসায় কুপিয়ে খুন করা হয় আমেরিকান সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও অভিনেতা খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময়কে।

জুলহাজ মান্নান যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা পদে কাজ করছিলেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাতো ভাই। অন্যদিকে তার বন্ধু খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময় ছিলেন লোকনাট্য দলের কর্মী। শিশু সংগঠন ‘পিপলস থিয়েটার’ এ ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসেবেও কাজ করতেন তিনি। এই দুই বন্ধুই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছিলেন।

সমকামী তরুণদের সংগঠন ‘বয়েজ অব বাংলাদেশের’ ‘রূপবান’ নামের সাময়িকী প্রকাশকে কেন্দ্র করেই খুন হন ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও অভিনেতা খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময়।
সমকামী তরুণদের সংগঠন ‘বয়েজ অব বাংলাদেশের’ ‘রূপবান’ নামের সাময়িকী প্রকাশকে কেন্দ্র করেই খুন হন ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও অভিনেতা খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময়।

২০১৩ সালে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যোগ দেওয়া জুবায়েরের বাসা চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদের জাকির হোসেন রোডে। আনসার আল ইসলামে যোগ দেওয়ার পর জুবায়েরের কাজ ছিল পেনড্রাইভ থেকে বিভিন্ন নথিপত্র, ছবি ও ভিডিও ডাউনলোড করে ২০০-২৫০ সিডিতে কপি করা। এজন্য আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে সম্মানী হিসেবে প্রতি মাসে ১১ হাজার করে প্রথম তিন মাসে তাকে দেওয়া হয় ৩৩ হাজার টাকা। পরের বছর জুবায়েরর সঙ্গে পরিচয় হয় আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে। এ সময় থেকে অন্তত এক বছর ধরে প্রতিমাসেই জুবায়ের সাংগঠনিক কাজে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতেন। চট্টগ্রাম থেকে অজ্ঞাতনামা লোকদের দেওয়া একটি বিশেষ ব্যাগ ঢাকায় বহিষ্কৃত মেজর জিয়ার কাছে পৌঁছে দিতেন জুবায়ের। পরে তিনি যোগ দেন আনসার আল ইসলামের গোয়েন্দা শাখায়।

২০১৮ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের একটি দল। পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওই সময় জানান, জুবায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা এবং পুরান ঢাকায় নাজিমউদ্দীন সামাদসহ অন্তত চারটি হত্যাকাণ্ডের যুক্ত ছিলেন। তিনি আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) নীতিনির্ধারণী শুরা কমিটির সদস্য। সংগঠনে তিনি শেখ আবদুল্লাহ, জায়েদ, জাবেদ, আবু ওমায়ের নামেও পরিচিত ছিলেন। জঙ্গি সংগঠনটির তহবিলের দেখভালও করতেন তিনি। জুবায়েরের হাত দিয়েই টাকা খরচ হতো বিভিন্ন খাতে। এবিটির সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যূত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে জুবায়েরের সরাসরি যোগাযোগ ও আলোচনা হতো। জুবায়েরের হাত দিয়ে অর্থ পেতেন জিয়াও। এছাড়া এবিটির সদস্যদের দালালের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করে আসছিলেন তিনি। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবিটির সদস্যদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের মধ্যস্থতাও করতেন জুবায়ের।

২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি জুবায়ের চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় অন্য জঙ্গিদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ওই বাসাতেই সম্ভাব্য খুনের পরিকল্পনাগুলো হতে থাকে। এ সময় তারা সমকামীসহ চার ধরনের লোককে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ২৯ বছর বয়সী জুবায়ের বলেন, ‘আমাকে সমকামীদের ব্যাপারে ব্যাপক খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি সমকামীদের ব্যাপারে ফেসবুক ও অনলাইনে খোঁজখবর নিতে থাকি। সে সময় প্রধান দুই সমকামী সংগঠন রূপবান ও বয়েজ অব বাংলাদেশ ছিল আমার টার্গেট। এই টার্গেটদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমি জায়েদ বিন ইফরান নামে একটি ফেসবুক আইডি খুলি। এই আইডি থেকে ফেসবুক ঘেঁটে রূপবানের সদস্যদের তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি।’

পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর রমনা পার্কে ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভালোবাসা দিবসে’ সমকামী তরুণদের সংগঠন ‘বয়েজ অব বাংলাদেশ’ আয়োজিত এক মিলনমেলায় নিজের পরিচয় গোপন রেখে সমকামী সেজে যোগ দেন আইআইইউসি ছাত্র জুবায়েরও। তার সঙ্গে ছিলেন আনসার আল ইসলামের গোয়েন্দা শাখার আরেক সদস্য হাসানও। সেখানে বাদাম বিক্রেতার বেশ ধরেছিলেন হাসান। তবে সমবেত সমকামীদের সঙ্গে জুবায়ের ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুললেও হাসান তাকে অনুসরণ করছিলেন দূর থেকে। সমকামী তরুণদের সংগঠন ‘বয়েজ অব বাংলাদেশ’ তখন ‘রূপবান’ নামের একটি সাময়িকী প্রকাশ করে আসছিল— যাতে সমকামীদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন লেখা ছাপা হতো। আমেরিকান সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্য অভিনেতা খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময় সাময়িকীটির তত্ত্বাবধান করতেন।

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে জুবায়ের চট্টগ্রামে ফিরে এলেও বহিস্কৃত মেজর জিয়া তাকে হঠাৎ খবর পাঠান, ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় সমকামীদের একটি মিছিল হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে যেন জুবায়ের যোগ দেন। এ সময় তারেক নামের আরেক সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জুলহাজ মান্নান ও খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময়ের বাসার ঠিকানা বের করার জন্য। তারেক জুলহাজ মান্নানের বাসার খোঁজ পেলেও তন্ময়ের বাসা খুঁজে পাননি। এরপর বহিস্কৃত মেজর জিয়ার পরিকল্পনায় জুলহাজ মান্নানকে ওই বছরের ২৫ এপ্রিল তার বাসায় গিয়ে খুন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের ছেলে আইআইইউসি ছাত্র জুবায়ের জবানবন্দিতে জানান, ২৫ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে জুলহাস মান্নানের বাসার সামনে অবস্থান নেন তিনি ছাড়াও আকরাম ওরফে আবির ওরফে আদনান ও হাসান। দুপুরের দিকে হাসান সেখান থেকে চলে গেলেও সেখানে থেকে যান জুবায়ের ও আকরাম। ওইদিন বিকাল ৫টার দিকে জুলহাস মান্নান হেঁটে বাসায় ফেরেন। এর ১৫ মিনিট পর জুলহাজদের বাসার সামনে পৌঁছান মাহবুব রাব্বী। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আনসার আল ইসলামের অপারেশন শাখার মোট পাঁচ সদস্য জুলহাজ মান্নানের বাসার গেটের সামনে অবস্থান নেন। এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের গায়ে ছিল ‘ই কুরিয়ার ডট কম বিডি’ নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ইউনিফর্ম আর গলায় ঝোলানো ছিল ভুয়া পরিচয়পত্র। সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় এই তিনজন জুলহাজের বাসায় পার্সেল নিয়ে ওঠেন। জুবায়ের ও আকরাম তার খানিকটা দূরে অবস্থান নেন।

বাসার সামনে কর্তব্যরত দুই নিরাপত্তারক্ষীর একজন ওই তিনজনের সঙ্গে ওপরে ওঠেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই জুলহাজের বাসার ভেতর থেকে আর্তচিৎকার শোনা যেতে থাকে। এ সময় জুবায়ের ও আকরাম বাসার ভেতরে ঢুকে পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়েন। কয়েক মিনিটের মাথায় আনসার আল ইসলামের পাঁচ সদস্যই হাতে চাপাতি নিয়ে দৌড়ে গেট থেকে বের হয়ে যান।

তবে জুলহাজ মান্নানের বাসা থেকে ৫০ গজ দূরে যাওয়ার পর আনসার আল ইসলামের পাঁচ সদস্যই জনতার ধাওয়ার মুখে পড়েন। এ সময় তারা ফাঁকা গুলি ছোঁড়েন। তবে এর মাঝেও জুনায়েদকে পুলিশ জাপটে ধরে। আকিল নামে অপর একজন তখন ওই পুলিশকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জুনায়েদকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর আসাদুল্লাহ ও জুনায়েদ গাজীপুরের বাসায় চলে যান। বাকি তিনজন ঢাকার বোর্ড বাজারের একটি শেল্টারে আত্মগোপন করেন।

ইউএসএআইডি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও অভিনেতা খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময় হত্যার এই ঘটনায় আসামি করা হয় সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক, আকরাম হোসেন, সাব্বিরুল হক চৌধুরী, মো. জুনাইদ আহমেদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, জুবায়ের ওরফে মো শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের এবং আসাদুল্লাহ ওরফে ফয়জুল ওরফে ফয়সালসহ মোট আটজনকে। এর মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক। বাকি চারজনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলাটির তদন্ত করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

পাঁচ বছর পর আজ মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কলাবাগানের আলোচিত এই জোড়া খুনের রায় ঘোষণার কথা রয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!