চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতার ভাই ঢাকায় বসে উস্কানি ও গুজব ছড়াচ্ছিলেন

ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে হিন্দুদের উত্তেজিত করার চেষ্টা ছিল

চট্টগ্রামের ছেলে আশীষ মল্লিক ও তার সহযোগীরা ঢাকায় বসে ফেসবুকে পেইজ খুলে ক্রমাগত মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের এক উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছিলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের হুমকি দিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান’। অনেক আগের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় পঞ্চগড় ও গাইবান্ধায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘর পুড়ে যাওয়াকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে অপপ্রচার চালান তারা। সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময়ে চাঁদপুর ও নোয়াখালীতে নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছেও বলেও গুজব ছড়িয়ে দেন তারা।

নড়াচড়া শুরু ১৬ অক্টোবর থেকে

এই সবকিছুই করা হচ্ছিল গত ১৬ অক্টোবর থেকে। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকার বনানী এলাকায় র‌্যাবের হাতে ধরা পড়লেন এই গুজবচক্রের মূল হোতা চট্টগ্রামের ছেলে আশীষ মল্লিক (৩০)। তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও গুজব ছড়ানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সাইবার অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করেছেন। আশীষের সহযোগী অন্য সদস্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

আশীষ মল্লিকের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডীতে। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেন। এরপর ২০১৭ সাল থেকে ফার্মগেটে ‘জেস্ট এডমিশন এন্ড একাডেমিক কেয়ার’ নামের একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছিলেন। এছাড়া তিনি আলোড়ন নিউজ নামের একটি কথিত অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসলেও বাস্তবে এই নামের কোনো অনলাইন পোর্টালের অস্তিত্ব নেই। গত ৮ অক্টোবর এই নামের ডোমেইনটির মেয়াদই শেষ হয়ে গেছে।

ছাত্রলীগ নেতার ছোট ভাই

আশীষ মল্লিক চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের আপন ছোট ভাই।

র‌্যাব মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) আশীষ মল্লিককে গ্রেপ্তারের কথা বললেও গত ২১ অক্টোবর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তার বড় ভাই ছাত্রলীগ নেতা সুভাষ মল্লিক সবুজ দাবি করেন, আশীষকে ২০ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭ টায় ঢাকা মালিবাগ রেলগেইট বাজার থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়।

চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতার ভাই ঢাকায় বসে উস্কানি ও গুজব ছড়াচ্ছিলেন 1

ওই ফেসবুক পোস্টে সুভাষ মল্লিক সবুজ লিখেছেন— ‘গতকাল (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা মালিবাগ রেল গেইট বাজার থেকে আমার আপন ছোট ভাই আশিষ মল্লিক, সম্পাদক আলোড়ন নিউজ। তাকে গুম করেছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লিখালিখি করার জন্য। শাহজাহানপুর থানায় ডায়েরি হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭ টায় ঢাকা মালিবাগ রেল গেইট বাজার থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়।’

অন্য দেশের ভিডিও দিয়ে রঙ ছড়ানো হতো

র‌্যাব জানিয়েছে, আশীষ মল্লিক ও তার সহযোগীদের ফেসবুক পেজে প্রতিবেশী দেশসমূহে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন নৃশংস ঘটনার ভিডিও আপলোড করে জনমনে ভয়ভীতি তৈরিসহ উস্কানি দেওয়া হচ্ছিল। অভিযুক্ত আশীষ মল্লিক প্রত্যেকটি পোস্ট হ্যাশট্যাগ করে দেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

র‌্যাব জানিয়েছে, গত ১৬ অক্টোবর একটি ফেসবুক পেজ খুলে ওই পেজে এবং তার ব্যক্তিগত আইডি থেকে বিভিন্ন উস্কানিমূলক পোস্ট দিতে থাকেন আশীষ। তিনি নিজেই পেজের অ্যাডমিন এবং তার সমমনা আরও কয়েকজনকে পেজের অ্যাডমিন হিসেবে সংযুক্ত করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই পেজের সদস্য ও অনুসারী কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই ফেসবুক পেজ থেকে কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা তথ্য প্রচার ও উস্কানিমূলক পোস্ট দেওয়া হচ্ছিল।

যেসব ছড়ানো হল গুজব

র‌্যাব জানিয়েছে, আশীষ মল্লিকের ফেসবুক পেজ থেকে পার্বত্য জেলার একজন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের হুমকি দিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান।’ যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।

নোয়াখালীতে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির পায়ের রগ কেটে পুকুরে ফেলে দেয়ায় মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয় এই পেজে। দুর্ঘটনায় পঞ্চগড় ও গাইবান্ধায় বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে অপপ্রচার করা হয়।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ৫নং গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের গুপ্টি গ্রামে বীরেশ্বর কর্মকারের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে বলে তিনি মনগড়া পোস্ট দেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই দেশে জন্মই যেন অভিশাপ বলেও মন্তব্য লেখেন তিনি।

এ ছাড়া চাঁদপুর ও নোয়াখালীতে ধর্ষণ চলছে বলেও অপপ্রচার করা হয়। রংপুরের ঘটনাকে ১৯৭১ সালের পুনরাবৃত্তি বলে তুলনা করা হয় পেজটিতে। সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে উস্কানিমূলক ও ভুল তথ্য দেওয়া হয় সেখানে।

র‍্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, আশীষের ধারণা, এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতিত। তাই তাদের নিয়ে নেতিবাচক ও বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের মাধ্যমে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উত্তেজিত হবেন। এটাই তার মোটিভ ছিল বলে আমাদের ধারণা। তবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

এর আগে গত ২৩ অক্টোবর ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে রিমন শীল নামের এক যুবককে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার ফিরিঙ্গিবাজার ইয়াকুব নগর থেকে আটক করে র‍্যাব। রিমন শীল চট্টগ্রাম বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাবার নাম বিজয় শীল। র‍্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাজধানী পল্লবীর সাহিনুদ্দীন হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নোয়াখালীর যতন সাহা হত্যাকাণ্ড বলে প্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে রিমনকে আটক করা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!