চট্টগ্রামের করোনার রাজনীতি মাস্ক বিতরণেই সীমাবদ্ধ

করোনা আতঙ্কের মধ্যে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতা ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। ঢাকায় যেখানে বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষদের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন এলাকা ও গণপরিবহন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে সেখানে চট্টগ্রামের চিত্র হতাশ করছে স্থানীয়দের। তারা বলছেন ‘লোকদেখানো’ কার্যক্রমের বাইরে বাস্তবতা বুঝে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা।

করোনা ইস্যুতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নাগরিকদের মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার আহবান জানান ২০ মার্চ। আবার একই বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার আলোকে সরকারের দেওয়া নির্দেশনাগুলো মেনে চলার আহবানও জানান তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগম এড়ানো। পরস্পরবিরোধী এই দুই বিবৃতির পর দিন ২১ মার্চ বিপুলসংখ্যক লোকের সমাবেশ ঘটিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারের গুলজার মোড়ে হাত ধোয়ার সামগ্রী বিতরণ করেন মেয়র। দুদিন পরে ২৩ মার্চ জনসমাগম এড়িয়ে চলতে নাগরিকদের সচেতন করতে মাইক হাতে রাস্তায় নামেন তিনি। সোমবার (২৩ মার্চ) নগরের লালখান বাজার, ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেইট, ষোলশহর রেল স্টেশন, মুরাদপুর, বহদ্দার হাট, চকবাজার, জামালখান, কাজীর দেউড়ি, আন্দরকিল্লা, বকসির হাটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাইকিংয়ের মাধ্যমে এ প্রচারণা চালান।

অন্যদিকে করোনা আতঙ্কের মধ্যে নির্বাচন চালিয়ে নেওয়ার পক্ষে নিজের অবস্থান জানান দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হওয়া আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমও সোমবার (২৩ মার্চ) থেকে মাস্ক বিতরণ করছেন শহরের বিভিন্ন স্থানে। সোমবার চট্টগ্রামের মোহরা, খাজা রোড, বহদ্দারহাট সহ বেশ কিছু স্থানে এসব মাস্ক বিতরণ করেন তিনি।

শুরু থেকে নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যে মাস্ক বিতরণ করে আসছিলেন নগর বিএনপির সভাপতি ও চসিক নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদত হোসেন। চিকিৎসক হয়েও জনসমাগম ঘটিয়ে মাস্ক বিতরণের ওই কর্মসূচি নিয়েও সমলোচনার অন্ত ছিল না। তবে করোনা ইস্যুতে ডা. শাহাদতের কার্যক্রম ওইটুকুই।

১৮ মার্চ বেলা ১২টায় নগরীর কাজীর দেউড়ি বাজারে বিক্রেতা ও ক্রেতা সাধারণের মাঝে জীবাণুনাশক সাবান, হেক্সিসল ও গ্লাভস বিতরণ করেন নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। পরের দিন চলমান পরিস্থিতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম না বাড়াতে পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। অন্যদিকে ২১ মার্চ নগরের ১০ হাজার মানুষের মাঝে হাতধোয়ার সামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেন নগর জাতীয় পার্টির সভাপতি সোলায়মান আলম শেঠ। যদিও ব্যস্ততম স্থানে জনসমাগম ঘটানোয় তার এই উদ্যোগ সমালোচিত হয় বিভিন্ন মহলে।

এদিকে নগরের কাউন্সিলরদের মধ্যে নিজ উদ্যোগে ঘরে বসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই স্যানিটাইজার তৈরির ঘোষণা দেন জহরলাল। তবে অন্য কাউন্সিলরদের কাউকে এরকম কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

তবে নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের এসব উদ্যোগকে অপর্যাপ্ত ও লোকদেখানো বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের স্থানীয়রা। তারা বলছেন ঢাকায় যেখানে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার পাশাপাশি এলাকায় এলাকায় হাত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এলাকায় এলাকায় কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। সেখানে চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত তেমন কোন উদ্যোগই নিতে দেখা যায়নি কোন সংশ্লিষ্টদের।

পাশাপাশি নগরের ৪ সাংসদ ও মন্ত্রীদের নীরবতা নিয়েও সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন অনেকে। তারা বলছেন, শুধুমাত্র হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণের কাজ করছেন এখানকার নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। এই দুটো কাজও খুব ভালভাবে করতে পারেননি তারা। অল্প কিছু জায়গায় লোকদেখানো কিছু কাজ করেই দায়িত্ব শেষ করছেন তারা। তারা বলছেন মূলত মানুষের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর ‘দায়বদ্ধতা’ না থাকার বিষয়টি প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে চলমান পরিস্থিতিতে। এক্ষেত্রে বিদ্যানন্দ সহ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবি নিজেদের সীমাবদ্ধ সক্ষমতা নিয়ে যেভাবে কাজ করে চলেছে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েও যদি রাজনৈতিক দলগুলো এই বিপর্যয় মোকাবেলায় কাজ করে তাহলে পরিস্থিতি মোকাবেলা অনেকটা সহজ হতো। তবে নেতারা বলছেন দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও কর্মসূচি হাতে নেবেন তারা।

রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাল থেকে কর্মীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন বস্তি ও প্রান্তিক মানুষের কাছে সাবান, স্যানিটাইজার পৌছানোর ব্যবস্থা করবো আমি। বিভিন্ন এলাকায় জীবানুনাশক কীটনাশকও ছিটাবো ব্যক্তিগত উদ্যোগে।’

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যখনই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে কোন নির্দেশনা আসবে আমরা কাজ শুরু করবো। এখানে প্রতিটা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমাদের কর্মীবাহিনী আছে। আমাদের যদি দায়িত্ব দেয় তাহলে আমরা মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌছে দেবো, ওষুধ পৌঁছে দেবো। আমরা সবাই মিলে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা করবো।’

মেহেদি হাসান শুভ নামে একজন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের নেতারা ও দলগুলো পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা হ্যান্ড সেনিটাইজার বিতরণ আর মাস্ক বিতরণের যে কর্মসূচিগুলো করছেন সেগুলো একেবারেই লোকদেখানো। রাস্তার মোড়ে শখানেক মানুষ জড়ো করে এসব বিতরণ করে ছবি তুলে দায়িত্ব শেষ করছেন তারা।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে কী ভূমিকা আশা করেন এমন প্রশ্নে আসিফ আহমেদ নামে একজন বলেন, ‘অনেক কিছুই করতে পারেন তারা। তারা চাইলে প্রতিটা পাড়ায় পাড়ায় টিম গঠন করে কাজ করতে পারেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশিক্ষিত কর্মী লাগবে। তাদের কর্মী বাহিনী আছে। তাদেরকে প্রস্তুত করে নেয়া যেত। একেবারে প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে মাস্ক , স্যানিটাইজার সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছে দিতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বিদ্যানন্দ যা করছে সে পদ্ধতিটাও যদি তারা অনুসরণ করে তাহলে তা যথেষ্ট। কিন্তু সে সদিচ্ছা তাদের কতটুকু আছে সেটাই বড় প্রশ্ন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!