চট্টগ্রামের আইসিইউতে বিরল ঘটনা, করোনায় ভোগা মায়ের কোলে যেভাবে এল ফুটফুটে শিশু

আইসিইউতে থাকা করোনা রোগীকে সিজার করানোর সুবিধা চট্টগ্রামের কোনো হাসপাতালেই নেই।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাতে প্রতি মিনিটে ৬০-৭০ লিটার গতিতে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল ঝুমা আক্তারকে। ২৩ বছর বয়সী এই নারীর পেটে অনাগত সন্তান। তাই নিজে তো বটেই, ঝুমা লড়াই করছিলেন একসঙ্গে আরও একটি প্রাণ বাঁচানোর জন্য। সেটি তার পেটে ধারণ করা ১০ মাস বয়সী সন্তানের প্রাণ— যে কিনা তখনও দেখেনি পৃথিবীর মুখ।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে শেষপর্যন্ত সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে নতুন এক ইতিহাস তৈরি করলেন এই তরুণী মা। সময়টা ছিল বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) রাত ৯ টা। আর এই লড়াইয়ে ঝুমাকে অনন্যসাধারণ সমর্থন যুগিয়েছেন হাসপাতালটির আইসিইউ ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্তান জন্ম দেওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা। আর বাচ্চা ডেলিভারির পুরো প্রক্রিয়াতেও যুক্ত ছিলেন না কোনো গাইনি চিকিৎসক। পুরোটাই সামলেছেন আইসিইউ ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা।

ঝুমা আক্তারের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তবে স্বামীর চাকরির সুবাদে থাকেন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এলাকায় বি-আর পাওয়ারজোনে কর্মরত প্রকৌশলী আব্দুল মোতালেবের স্ত্রী ঝুমা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে। ঝুমার সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখ ছিল জুলাইয়ের ২৯ জুন। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তাকে প্রথমে মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় চট্টগ্রাম শহরে।

গত ২৮ জুন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি হন ঝুমা। শুরুতে ঝুমার হাই ফ্লো অক্সিজেন সাপোর্ট লাগেনি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির আইসিইউ ওয়ার্ডের চিকিৎসক ডা. সাকিব। তবে একদিনের ব্যবধানে হঠাৎ অবস্থার অবনতি হয় ঝুমার।

শুরুতে শুধুই করোনা আক্রান্ত স্ত্রীকে শ্বাসকষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য মা ও শিশু হাসপাতালের ভর্তি করিয়েছিলেন জানিয়ে ঝুমার স্বামী মোকাররম বলেন, ‘ওর ডেলিভারির তারিখ ছিল ২৯ জুলাই। আরও প্রায় এক মাস পর। সন্তান প্রসবের জন্য নয় শুধু মাত্র করোনায় উচ্চমাত্রার অক্সিজেনের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই তাকে মা ও শিশু হাসপাতালের ভর্তি করি আমি।’

মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউর চিকিৎসক ডা. সাকিব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘২৯ জুন হঠাৎ ঝুমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওই সময় থেকে টানা দুইদিন ঝুমাকে ৬০ থেকে ৭০ লিটার পার মিনিট প্রেসারে অক্সিজেন দিতে হয় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে।’

আইসিইউতে দুইদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সকালে ঝুমার প্রসব বেদনা শুরু হয়। মাঝের এই সময়টা ঝুমার পরিবার বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করে। তবে কোথাও কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঝুমার ডেলিভারি প্রসেস শুরু করেন মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা। শেষ পর্যন্ত রাত ৯ টার দিকে ঝুমা জন্ম দেন একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের।

মাঝের এই ১০-১২ ঘন্টা সময়টা ঝুমার স্বামীর কেটেছে হাসপাতালে হাসপাতালে কড়া নেড়ে। ওই সময়ের বর্ণনা দিয়ে মোতালেব বলেন, ‘১ জুন সকালের দিকে তার পেইন শুরু হয়। প্রথমে এটাকে কেউই লেবার পেইন ভাবেনি। পরে যখন বুঝলাম, তখন তো অবস্থা খারাপ। আইসিইউতে থাকা একটা রোগীকে সিজার করাতে হবে। অথচ চট্টগ্রামে কোনো হাসপাতালে এই সুবিধা নেই। আমি অনেকগুলো হাসপাতালে যোগাযোগ করি। সবাই আমাকে এক শব্দে ‘না’ বলে। শুধু ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল প্রথমে রাজি হয়। পরে বিভিন্ন দিক ভেবে তারাও না করে দেয়।’

শেষ পর্যন্ত মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে স্ত্রীর সন্তান প্রসবের আয়োজন সম্পর্কে মোতালেব বলেন, ‘যখন কোথাও কোন সুযোগ পাচ্ছি না, তখন ঝুমা গর্ভবতী হওয়ার পর যে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসাধীন ছিলেন তার সাথে যোগাযোগ করি আমি। তিনি সব ডিটেইলস জেনে আমাকে পরামর্শ দেন পরিস্থিতি যাই হোক আমরা যেন মাটি কামড়ে মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডেই থেকে যাই। আর আইসিইউর চিকিৎসকরাও জানান, আমি পুরো দায়িত্ব নিলে উনারা চেষ্টা করে দেখবেন। তখন আমি উনাদের বলি যে আপনারা কোনো ভয় পাবেন না। শুধু আন্তরিকতা রেখে চেষ্টা করবেন। উনারা শেষ পর্যন্ত সেটাই করেছেন। ডাক্তার-নার্স-ওয়ার্ডবয় সকলেই খুব আন্তরিক ছিলেন।’

চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্তান জন্ম দেওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা। এছাড়া কোনো গাইনি ডাক্তার নন, এই পুরো প্রক্রিয়াটাই সামাল দিয়েছেন আইসিইউর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকরা। তবে ভিন্নভাবে এই পুরো সময়ে সংযুক্ত ছিলেন হাসপাতালটির লেবার ইউনিটের চিকিৎসকরাও।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সাকিব বলেন, ‘যেহেতু আমাদের এই ওয়ার্ডটায় গাইনি সেবা ডেডিকেটেড না, এখানে এমন সেটিংস ছিল না। প্রথমে তারা বাইরে যোগাযোগ করছে। কিন্তু বাইরে কোথাও এমন সুযোগ ছিল না। পরে এখানে যারা আইসিইউতে দায়িত্বশীল ছিল, তারাই ডেলিভারি কন্ডাক্ট করেছেন। গাইনি ওয়ার্ডের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করে উনাদের ইন্সট্রাকশন অনুসারে আইসিইউ ডাক্তাররা এটা কন্ডাক্ট করেন। সকাল থেকে ঝুমার দেখভাল করছিলেন ডা. মাকসুদা হক মিতা। রাতে যখন তিনি সন্তান প্রসব করেন তখন ডা. রিহুলও ছিলেন।’

সন্তান প্রসবের পর এখন ঝুমার অবস্থা আগের চেয়েও উন্নতি হয়েছে জানিয়ে ডা. সাকিব বলেন, ‘এখন উনার ৩০ লিটারে মেনটেইন হচ্ছে। অবস্থা উন্নতির দিকে।’

অন্যদিকে নবজাতক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শিশুটিকে আইসোলেটেড করে রাখা হয়েছে। সে সাপ্লিমেন্টাল ফুড পাচ্ছে। বাচ্চাকে শিশু বিভাগে রেফার করা হয়েছে। ওদের আন্ডারেই আছে।’

এর আগে গত বছরের ৯ জুন এমন অবস্থায় পড়ে বাচ্চাসমেত পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মুক্তা (৩০) নামের এক নারী। করোনা পজিটিভ না হয়েও করোনার উপসর্গ থাকায় পেটে ১০ মাসের বাচ্চা নিয়ে ১৮ ঘন্টা চট্টগ্রামের সব হাসপাতাল ঘুরেও কোনো চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান মুক্তা। ওই সময়ে মুক্তার মৃত্যু নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল চট্টগ্রাম প্রতিদিন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!