চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীই ডিজে নেহার ‘ক্লায়েন্ট’, মোবাইলভরা ফোন নম্বর

নেহাকে নিয়ে ‘বিদেশ ট্যুর’ পাকা ছিল দুই ব্যবসায়ীর

ঢাকার আলোচিত ডিজে নেহা চট্টগ্রামের এক নামি গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছ ৫ মাসে হাতিয়ে নেন ১৫ লাখেরও বেশি টাকা। তিনি এক লাখ ৩৭ হাজার টাকা দামের যে আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্স ব্যবহার করেন, সেটিও চট্টগ্রামেরই এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া।

শুধু এই ব্যবসায়ীই নয়, নেহার সঙ্গে খাতির ছিল চট্টগ্রামের আরও ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির ছেলের। তারা প্রায়ই নেহা ও তার সংগ্রহ করা তরুণীদের নিয়ে দেশের বাইরে ‘ট্যুরে’ যেতেন। করোনা শুরু হওয়ার ঠিক আগেও চট্টগ্রামের দুই ব্যবসায়ীর আমন্ত্রণে এ ধরনের ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল নেহাসহ অপর এক তরুণীর।

এভাবে বিভিন্ন সূত্র ধরে পরিচয় হওয়া চট্টগ্রামের বেশকিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নানা কৌশলে বিভিন্ন সময়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ঢাকার ‘পার্টি গার্ল’ নেহা।

গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে পার্টিতে মদপানের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর আজিমপুরের একটি বাসা থেকে নেহাকে গ্রেফতার করা হয়। নিহত ওই ছাত্রীর বান্ধবী ফারজানা জামান নেহা ওরফে ডিজে নেহাকে পরে রিমান্ডে নেওয়া হলে বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। দিচ্ছেন নিজের অন্ধকারজগৎ সম্পর্কে নানা তথ্যও।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে নেহার ‘ক্লায়েন্ট’ হাতেগোনা হলেও ঢাকায় ছিল তার অসংখ্য শিকার। ডিজে নেহার আইফোনে টার্গেট করা ব্যবসায়ী ও বিত্তবান তরুণদের নম্বর ‘ক্লায়েন্ট-১’, ‘ক্লায়েন্ট-২’, ‘ক্লায়েন্ট-৩’— এমন নামেই সংরক্ষণ করা আছে। কারও কারও নাম অবশ্য প্রথম বর্ণ দিয়েও সেইভ করা আছে ফোনবুকে।

রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) রিমান্ডের তৃতীয় দিনে ডিজে নেহার ফোনবুকে পুলিশ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ডজনখানেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর ফোন নম্বর খুঁজে পেয়েছে— যেগুলো সাংকেতিকভাবে সংরক্ষণ করা। এসব শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছে মদ ও মেয়ে সরবরাহ করতেন ডিজে নেহা। অনেক সময় নেহা নিজেও তাদের শয্যাসঙ্গী হয়েছেন। বিনিময়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নেহা জানিয়েছেন, গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটি পার্টিতে তার পরিচয় হয়। শুরু থেকেই ওই ব্যবসায়ী বেশ আকৃষ্ট ছিলেন তার প্রতি। এরপর ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা বলে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ওই গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন নেহা। নেহার ব্যবহৃত এক লাখ ৩৭ হাজার টাকা দামের আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্সও ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই নেওয়া। চট্টগ্রামের ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ ছিল আরও কয়েক ডিজে ও মডেলের। এরই মধ্যে ওই গাড়ি ব্যবসায়ীর এক ফেসবুক বন্ধুর সঙ্গেও পরিচয় হয় নেহার। এভাবেই আরও অনেক ব্যবসায়ীকে মাদক ও নারীসঙ্গের জালে জড়িয়েছিলেন নেহা।

চট্টগ্রামের মাহতাব নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় ছিল নেহার। পরে নেহার মাধ্যমে অনেক তরুণীদের সঙ্গে পরিচয় হয় মাহতাবের। তারপর তাদেরও ডাকতেন। নিজের কাছে ছাড়াও পাঠাতেন বিভিন্নজনের কাছে। চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ীরা প্রায়ই তরুণীদের দেশের বাইরে নিয়ে যেতেন। করোনার লকডাউন শুরু হওয়ার সময়ও চট্টগ্রামের দুজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে নেহাসহ আরেক তরুণীর বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।

নেহার ফোনের কললিস্ট যাচাই করে পাওয়া গেছে অনেক ব্যবসায়ীদের পরিচয়— যাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো তার। তার মোবাইলফোনের হোয়াটসঅ্যাপে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদেবার্তা। বিভিন্ন ধরনের ছবি, ভিডিও, টিকটকে পোস্ট করা ক্লিপ। এসব ছবিতে নেহাকে দেখা গেছে স্বল্পবসনা অবস্থায়। আর তার পাশে বসা ও দাঁড়ানো অবস্থায় যুবক ও মধ্যবয়সী কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেছে। এই পুরুষদের ছবি রয়েছে অনেক তরুণীর সঙ্গেও।

রিমান্ডে এসে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন নেহা। কখনও কখনও রেগে যাচ্ছেন। তবে নেহা জানান, সমাজে ভালো মানুষের মুখোশপরা যারা, তাদের অনেকের আসল চরিত্র তার জানা। এখন তাকে সবাই খারাপভাবে দেখছে। কিন্তু যারা তাকে ডাকেন, যারা এসব পার্টিতে অংশ নেন, রাতভর নারী ও মদে বুঁদ হয়ে থাকেন— তাদেরকে কেউ খারাপ বলার সাহস পাবে না। তবে তিনি কারও নামও বলতে চান না।

নেহার এসব কাজে সহযোগিতা দিতে সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গে থাকতেন তারই চাচাতো ভাই শাফায়াত জামিল বিশাল। নেহার খদ্দেরদের তালিকাও সংরক্ষণ করতেন বিশাল। এছাড়া অবৈধ দরদামে তিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর পর তার বাবার মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে নিজেই আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন বিশাল।

গত ২৮ জানুয়ারি উত্তরার ব্যাম্বু স্যুট রেস্টুরেন্টে মদপান করাতে নেহা ও তার খুব কাছের বন্ধু আরাফাত পার্টির আয়োজন করেন। মদপানের পর অসুস্থ হয়ে আরাফাতও মারা গেছেন। সেদিন নেহার ফোনেই তার চাচাতো ভাই শাফায়াত জামিল ওরফে বিশাল এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে মদ কিনে নিয়ে যায় ওই রেস্টুরেন্টে।

এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নেহা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘গত ২৮ জানুয়ারি আমার বন্ধু আরাফাতের নিমন্ত্রণে উত্তরার ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যাই। সেখানে গিয়ে আরো কয়েকজনকে দেখতে পাই। আমি আরাফাত ছাড়া অন্য কাউকে চিনতে পারিনি। সেখানে আমি মদপান করি। তিন পেগ পান করার পর আমার মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় এবং বমিও হয়। আমি তখন সেখান থেকে বাসায় চলে যাই। বাসায় যাওয়ার পরও আমার কয়েক দফা বমি হয়। এমন পরিস্থিতিতে আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!