‘চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা’র মুখে যুদ্ধদিনের স্মৃতি

শরীয়তপুরে জন্ম হলেও পিতার চাকুরির সুবাদে ছোট্ট থেকেই চট্টগ্রামে বসবাস খালেদা খানমের। নন্দনকানন স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ এবং পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটেছে তার শিক্ষাজীবন। ১৯৬৬ সাল থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে পড়ার সময় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে চলে আসেন।

এছাড়া ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও সক্রিয় ছিলেন খালেদা। আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি মহিলা সম্পাদিকা হিসেবে নির্বাচিত হন। সেসময় চট্টগ্রামে মহিলা রাজনীতিকের সংখ্যা খুব কম ছিল বলে একই সাথে মহিলা আওয়ামী লীগের সাথেও কাজ করতেন খালেদা খানম। শুধু তাই নয়, তারা পাঁচ বোনই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ফলে তাদের বাড়ি ছাত্রলীগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন, বৈঠক করতেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পালং থানায় সফল অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন খালেদা খানম এবং তার সহযোদ্ধারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিতেন বীর সাহসী নারী খালেদা খানম।

‘আমাদের বাড়ি থেকেই পালং থানায় অভিযান চালানো হয়। আমরা দেখলাম, পালং থানা দখল করতে না পারলে শরীয়তপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাফেরা ও কর্মকাণ্ড খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন মাদারীপুরে থাকতো, তখন স্পিড বোটে করে তাদের শরীয়তপুর আসতে মাত্র ১০-১৫ মিনিট লাগতো। এছাড়া পালং থানায় পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ছিলই। এ অবস্থায় আমরা পরিকল্পনা করলাম স্টুয়ার্ড মুজিবের নেতৃত্বে পালং থানা দখল করার। তখন আমাদের বড় বড় চারটা ঘর ভর্তি অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ছিল। আরো কিছু সামনের সারির মুক্তিযোদ্ধা এসে হাজির হলেন। আমি মেয়েদের নিয়ে বৈঠক করলাম। পালং থানা অভিযানে আমি, আমার বোন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের কয়েকজন অংশ নিলাম। তখন অনেক বর্ষা। নৌকায় করে আমাদের সেই অভিযানে যেতে হয়েছিল। আমরা পরিকল্পনা মাফিক সফলভাবে পালং থানা অভিযান চালিয়েছিলাম। আমাদের দখলে চলে আসে পালং থানা। কিন্তু এরপরই আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি থাকার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। একদিন পাক সেনারা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে আসে। তারা লঞ্চে করে আমাদের বাড়ির বেশ কাছেই চলে এসেছিল। কিন্তু পথে একটি খাল কাটা ছিল। ফলে সেখান দিয়ে সৈন্যরা আসতে দেরি হয়েছিল। আর এসময় একটি ছোট্ট ছেলে চিৎকার দিয়ে জানিয়ে দেয় সৈন্যদের আসার খবর। ফলে সেদিন আমরা দ্রুত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাই’— এভাবেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নিজেদের অভিযানের কথা জানিয়েছেন বীর সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা খালেদা খানম।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নানা ঘটনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি উঠে যাওয়ার পর দোমসার, দাসাত্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি করা হয়। কিন্তু একটি জায়গায় খুব বেশি দিন ঘাঁটি রাখা যেতো না। আমি প্রায়ই নৌকাতে অস্ত্র বোঝাই করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বলতাম, আপনারা অস্ত্র বহন না করে খালি হাতে চলে যান। আমি আপনাদের জায়গামতো অস্ত্র পৌঁছে দেবো। তা নাহলে যোদ্ধারা পথে ধরা পড়ে যেতেন। কিন্তু আমি যখন নৌকায় করে অস্ত্র নিয়ে যেতাম, তখনও রাজাকার এবং পাক সৈন্যরা আমাকে নৌকা নিয়ে ঘাটে ডাকতো। আমি তাদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য মাঝেমাঝে আমার চাচাতো বোনকে নতুন বউ সাজিয়ে নৌকায় নিয়ে যেতাম। একদিন পাক সেনারা আমাকে ডাক দেয়। কিন্তু আমি জানি, ধরা পড়লে নৌকাভর্তি অস্ত্র তাদের হাতে চলে যাবে। আবার আমি সব মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা জানি – সেগুলো ওরা পেয়ে যেতে পারে। ফলে একবার অস্ত্র পানিতে ফেলে দেওয়ার কথা ভাবি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন অলৌকিকভাবেই বেঁচে যাই। আমাদের মাঝি বেশ চালাক ছিল। সে পাক সেনাদের একটি বাড়ি দেখিয়ে বলল, ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। এরপর আমাদের ওরা ছেড়ে দিয়েছিল।’

খালেদা খানম এবং তার সহকর্মীরা বিশ্বাস করতেন, দেশ স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই খালেদা গুরুত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করতেন। এছাড়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে উঠান বৈঠক করার সময় তিনি সঙ্গে কাগজ আর কলম রাখতেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী নারীদের নাম-ঠিকানা লিখে নিতেন। পরে তাদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ দিতেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে খালেদা খানম বলেন, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের নারীরা যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এতোটা সাহায্য না করতো তাহলে এতো কম সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়া সম্ভব ছিল না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শরীয়তপুর থেকে চট্টগ্রাম ফিরে যান সংগ্রামী নারী খালেদা খানম। আবারও লেখাপড়া শুরু করেন এবং পাশাপাশি দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। খালেদা খানম সেই স্কুল জীবন থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এতোটাই সক্রিয় এবং সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন যে, এখানকার মানুষ তাকে ‘চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা’ বলে ডাকতো। পরে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঢাকায় গিয়ে তিনি কেন্দ্রে দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া প্রচার সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন এই সাহসী নারী নেত্রী। এছাড়া লালমাটিয়া কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন এবং বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন খালেদা খানম।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!