চট্টগ্রামজুড়ে দিনরাত লোডশেডিং, ১৬০০ মেগাওয়াটের মধ্যে মিলছে মাত্র ১ হাজার

চট্টগ্রামের ৬ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রই বন্ধ

ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের ঘূর্ণিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম। দিনে-রাতে সমানতালে চলছে লোডশেডিং। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চট্টগ্রাম জানিয়েছে, লোডশেডিংয়ের পরিমাণ এখন ২০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট। কখনও কখনও আবার সেটা ৪০০ মেগাওয়াটও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে এমন মাত্রাছাড়া লোডশেডিংয়ে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবন ছাড়াও অফিস-আদালতের কার্যক্রম পড়েছে হুমকির মুখে। দিন-রাতের সমানতালে লোডশেডিংয়ের সঙ্গে পড়ছে অসহনীয় গরম। সবমিলিয়ে নাগরিক জীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর অনেক এলাকায় অনেক সময় বিদ্যুৎ আসলেও এর স্থায়িত্ব থাকছে দুই মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট পর্যন্ত। তবে চট্টগ্রাম পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীরা বলছেন, সমন্বয় ঠিক রাখতে বিদ্যুতের শাটডাউন করতে হচ্ছে। আর এর প্রধান কারণ জ্বালানি সংকট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জোনে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বর্তমানে ২০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট হলেও সেটি আবার অনেক সময়ই ৪০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম পিডিবির সুপারভাইজরি কন্ট্রোল এন্ড ডাটা অ্যাকুইজিশনের (স্ক্যাডা) নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জ্বালানি সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। গ্যাসের প্রেসার ও জ্বালানি তেলের সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের পরিমাণ অনেক সময় পরিবর্তন হচ্ছে। আসলে বিদ্যুতের সরবরাহের ওপরই নির্ভর করছে লোডশেডিংয়ের নির্ধারিত মাত্রা।

প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই মুহূর্তে জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে সরবরাহ আছে ১ হাজার ৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

জানা গেছে, কাপ্তাই হাইড্রোলিক পাওয়ার প্ল্যান্ট-১ এ (৪৬ মেগাওয়াট) বর্তমানে পুরোটাই বন্ধ। কাপ্তাই হাইড্রোলিক পাওয়ার প্ল্যান্ট-২ এ (৪৬ মেগাওয়াট) সরবরাহ আছে। কাপ্তাইয়ের ৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মিলছে ৪৬ মেগাওয়াট। কাপ্তাইয়ের অপর ৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ৩৫ মেগাওয়াট।

অপরদিকে ২১০ মেগাওয়াটে রাউজান-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৯০ মেগাওয়াট। ২১০ মেগাওয়াটের রাউজান-২ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোটাই বন্ধ এখন। জুডিয়াক ৫৪ মেগাওয়াট থেকে মিলছে ৩৫ মেগাওয়াট। ১১০ মেগাওয়াটের বারাকা কর্ণফুলী থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে পুরোটাই। ১৫০ মেগাওয়াটের শিকলবাহা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট পুরোটাই বন্ধ বর্তমানে।

২৪ মেগাওয়াটের রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ২১ মেগাওয়াট। ৫০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মিলছে ৮ মেগাওয়াট। ১০০ মেগাওয়াটের জুলধা-১ পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০ মেগাওয়াট। ১০০ মেগাওয়াটের জুলধা-২ পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মিলছে ৫০ মেগাওয়াট। একইভাবে ১০০ মেগাওয়াটের জুলধা-৩ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৭৬ মেগাওয়াট। ২৬ দশমিক ৭ মেগাওয়াটে আরপিসিএল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৫ মেগাওয়াট। ১০০ মেগাওয়াটের দোহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৮৯ মেগাওয়াট।

১০০ মেগাওয়াটের হাটহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন পুরোটাই বন্ধ। ৫০ মেগাওয়াটের বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মিলছে ৩৭ মেগাওয়াট। ১০০ মেগাওয়াটের এনার্জিপ্যাক পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৯০ মেগাওয়াট। ৩০০ মেগাওয়াটের আনোয়ারা পিকিং প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৬৫ মেগাওয়াট। অন্যদিকে ২২৫ মেগাওয়াটের শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানে পুরোটাই বন্ধ।

পিডিবি চট্টগ্রাম জোনের উপসহকারী প্রকৌশলী সামসুদ্দিন আজাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মূলত জ্বালানি সংকটের কারণেই পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা বিদ্যুৎ জেনারেশনের তালিকা করি প্রতিদিন সকাল সাতটা আর রাত ৭টায়। তাই জেনারেশনে ভ্যারিয়েশন থেকে যায়।’

পিডিবি চট্টগ্রাম জোনের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই বদল হচ্ছে। তাই কখন কী হবে বলা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয়ভাবে যে নির্দেশনা আসছে আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’

বিদ্যুতের পরিস্থিতি কি এর চেয়েও বেশি খারাপ হতে পারে— এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে? এরপরে হলে অবস্থার উন্নতিই হবে।’

এদিকে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষ পড়েছেন অসহনীয় দুর্ভোগে। অফিস-আদালতে এমনকি আইপিএস দিয়েও বিদ্যুৎ সংযোগ অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না ।

চট্টগ্রামের মিডিয়াপাড়া নামে খ্যাত জামালখান ও কাজীর দেউড়ি পিডিবির স্টেডিয়াম ডিভিশনের আওতায় থাকায় সংবাদপত্র অফিসগুলোতেও ভোগান্তি বেড়েছে। কারণ এ ডিভিশনে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১০ ধেকে ১৫ মেগাওয়াট। অথচ পিডিবির স্টেডিয়াম ডিভিশনে চাহিদাই থাকে ১৫ থেকে ২০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার পুরোটাই এখন লোডশেডিংয়ে ডুবে আছে।

এদিকে ঋতুবদল ও প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে নানা অসুখ, বিশেষ করে ডায়রিয়া, জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। অনেকে হিটস্ট্রোকেও পড়ছেন। গরমে পানি পানের অভাবে মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে নগরীর বাসায় বাসায় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে বেড়েছে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের রোগীর ভীড়।

চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাটের আসকারাবাদ এলাকা আগ্রাবাদ ডিভিশনের ১৪ নম্বর ফিডারের আওতাভুক্ত। গত সোমবার দিন ও রাত মিলে এ ফিডারে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে ১৭ বার। ওই এলাকার বাসিন্দা হাফেজ হুজুর বলেন, ‘আমি এরকম লোডশেডিং আগে কখনও দেখিনি।’

তার সাথে কথায় সায় দিলেন দোকানদার ইউনুছ আলীও। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় কাস্টমার এসে গরমে দোকানে বসতে চায় না। বেচা-বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!