চট্টগ্রামজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মশা, দায়সারা মশা-নিধনে ক্ষুব্ধ মানুষ

করোনার মধ্যেই ছড়াতে পারে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ

প্রতি শীতের শুরুতেই চট্টগ্রাম মহানগরী পরিণত হয় ‘মশার নগরী’তে। নগরবাসীর কানের কাছে বেজে চলে মশার গান। ঘরে-বাইরে মশার কামড়ে চলাফেরাই দায় হয়ে পড়ছে নগরবাসীর। এই মশা মারতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতি বছর কোটি টাকা খরচ করে। কেনা হয় নতুন যন্ত্রপাতিও। টাকা খরচ হয়, ওষুধও কেনা হয়। কিন্তু তাতে মশা মরে না।

কেন মরে না— এ প্রশ্নের অনুসন্ধানে নগরবাসীর অভিমত বরাবরই একই— মশার ওষুধের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় মশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মহানগরীর আনাচে-কানাচে। দিনরাত ২৪ ঘন্টাই মশার কামড়ে জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে মশার উপদ্রব কোথায় নেই! চান্দগাঁও থেকে বহদ্দারহাট, বাকলিয়া থেকে চকবাজার, শুলকবহর থেকে মুরাদপুর, মেয়র গলি থেকে ষোলশহর, হালিশহর থেকে আগ্রাবাদ. জামালখান থেকে রাহাত্তারপুল, পাহাড়তলী থেকে কাট্টলী, পতেঙ্গাসহ নগরীর সব জায়গাতেই যেন চলছে মশার মহোৎসব। সন্ধ্যার পর উৎপাত বাড়লেও দিনের বেলায়ও অনেক এলাকায় মশার কামড়ে ঘরে কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে।

এদিকে মশার অস্বাভাবিক উৎপাতে করোনা আতঙ্কের মধ্যেই নগরীতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত নানা রোগ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব এবং মশানিধনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা অনুসরণ না করাতেই মূলত মশার উপদ্রব থামছে না নগরীতে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় কার্যত নিষ্ক্রিয় সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশকনিধন শাখা। পরিচ্ছন্ন বিভাগের অধীনে ম্যালেরিয়া ও মশকনিধন শাখা থাকলেও তার কোনো কার্যক্রম নেই। এই শাখার অধীনে একজন ম্যালেরিয়া ও মশকনিধন কর্মকর্তা এবং ছয়জন কীট সংগ্রহকারীর পদ রয়েছে। কিন্তু এক যুগ ধরে এসব পদ রয়েছে শূন্য। ফলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল ছাড়াই চলছে মশা মারার কার্যক্রম।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মশকনিধন কর্মসূচিতে ৪ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এই টাকা দিয়ে অ্যাডাল্টিসাইড (উড়ন্ত বা পূর্ণবয়স্ক মশা মারার ওষুধ), লার্ভিসাইড (মশার শূককীট নিধনে ব্যবহৃত) ও ফগার মেশিন কেনা হয়েছে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা কল্যাণ সংস্থা থেকে ৯০০ টাকা করে ১০ হাজার লিটার (৯০ লাখ টাকা) লার্ভিসাইড কেনা হয়েছিল। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এবং ২০১৯ সালের মে মাসে ২৫ হাজার করে মোট ৫০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড কেনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এতে ব্যয় হয় দুই কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে মজুত রয়েছে ১২ হাজার ৪৮৬ লিটার। দুই লাখ ২৮ হাজার টাকা করে ৫০টি ফগার মেশিন কিনতে ব্যয় হয় এক কোটি ১৪ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে কেনা এসব মেশিনের সাতটি বর্তমানে নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় সভাপতি মো. আতিয়ার রহমান বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণ বা নিধনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। মশা যাতে জন্মাতে না পারে, সে জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মশার লার্ভা ধ্বংসে কীটনাশক ছিটানো, উড়ন্ত বা পূর্ণবয়স্ক মশানিধনে ধোঁয়া মারা (ফগিং করা) এবং জৈবিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সিটি করপোরেশন তো করবেই, পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে নগরবাসীকেও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ হাতে নিতে হবে এখনই।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৪ নভেম্বর মশক নির্ধন কার্যক্রম শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এ কার্যক্রমের আওতায় মশার প্রজনন রোধে খাল পরিস্কার শুরু করে চসিক। এরপর ৬ নভেম্বর নগরীর মাস্টারপোল এলাকা থেকে ওষুধ ছিটানোর কাজ শুরু করে চসিক।

চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ বরাবরের মতো এবারও দাবি করছে তাদের মশক নিধন কার্যক্রম সুচারুভাবেই পরিচালনা করা হচ্ছে। অন্যবারের মতো এবারও প্রতিটি ওয়ার্ডে চারটি জোনে ভাগ করে প্রতিদিন ওষুধ ছিটানো হচ্ছে বলে তাদের দাবি। এরই মধ্যে গত ১১ নভেম্বর মশক নিধন কার্যক্রম তদারকির জন্য আট সদস্যের মনিটরিং সেলও গঠন করে চসিক। আবার গত বছরে রিজার্ভে থেকে যাওয়া মশার ওষুধ নতুন করে পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

কিন্তু এসব কার্যক্রমের কোনো সুফল নগরবাসীর চোখে পড়ছে না। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ওষুধ ছিটানোর পর সেখানেই সদর্পে মশা গিজগিজ করছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আতিয়ার রহমান বলেন, ‘ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, জাপানিজ এনকেফালাইটিসসহ আরও অনেক রোগের বাহক মশা। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত মশার প্রজনন বেড়ে যায়। আর শীতকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নালা-নর্দমায় পানির স্থিরতা বেড়ে যায়। ফলে মশার প্রজননও অন্য সময়ের তুলনায় বাড়ে।’

অন্যদিকে চিকিৎসকদের মতে, বৃষ্টিপাতের আগে স্বাভাবিক কারণেই মশার উপদ্রব বাড়ে। এ সময় ম্যালেরিয়া ও চর্ম রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। মশার কামড়ে বিশেষ করে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও চর্ম রোগের প্রকোপই বেশি হয়।

চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগে মশা নিয়ন্ত্রণে বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য দিনগুলোতে নালা-নর্দমায় ‘লাইট ডিজেল এবং লিমব্যাক’ (লাল তেল নামে পরিচিত) নামক মশার ডিম ধ্বংসকারী একটি তেল ছিটানোর ক্রাশ প্রোগ্রাম নগরজুড়ে দৃশ্যমান ছিল। সেই সময় মশা নিধনে ‘এডালটিসাইড’ (পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী) এবং ‘লার্ভিসাইড’ (ডিম ধ্বংসকারী) নামে দুই ধরনের ওষুধ ছিটাতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু বর্তমানে সেটাও আর চোখে পড়ে না।

নগরীর রাহাত্তারপুল এলাকার হাশেম সওদাগর নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বললেন, ‘আগে তাও দেখতাম সিটি করপোরেশন ধোঁয়ার সাথে তেলজাতীয় কিছু ছিটাতো। এতে মশার উৎপাত কিছুটা হলেও কমতো। এখন তো দেখি সেটাও আর নেই।’

মশা নিধনে বর্তমান সার্বিক প্রস্তুতি জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা সাইফুল মান্না সিদ্দিকীর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও অপর প্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।

আইএমআই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!