চট্টগ্রামজুড়ে ঘরে ঘরে জ্বরের অদ্ভূত আচরণ, আগ্রহ নেই করোনা পরীক্ষায়

ঋতুবদল নয়, ঋতুর বৈরিতায় জ্বরের হানা— বলছেন ডাক্তাররা

চট্টগ্রামজুড়ে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রায় ঘরে ঘরেই এখন এ ধরনের রোগী। তবে করোনাসন্দেহে জ্বর নিয়ে ভীতি থাকলেও করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন, করোনা মহামারির এই সময়ে যে কারণেই সর্দি-কাশি-জ্বর দেখা দিক না কেন, অবহেলা না করে হতে হবে সাবধান। নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে নিতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ।

দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকলেও কিছুতেই মানতে চান না যে তারা করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। এভাবেই জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা করোনা পরীক্ষায় একেবারেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে ডাক্তাররা বলছেন, আবহাওয়ার কারণেও জ্বর বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের আশঙ্কাকেও কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটের ফরিদাপাড়ার নেসার উদ্দিন কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। জ্বরের সঙ্গে সর্দি-কাশি আছে। দুইদিনের মাথায় তার স্ত্রীও জ্বরে আক্রান্ত হন। একে একে দুই বাচ্চাও জ্বরে পড়ে। তবে বাড়ির পাশের একজন এমবিবিএস ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে সাতদিন পর মোটামুটি সবাই এখন সুস্থ।

অন্যদিকে নগরীর ২ নম্বর গেইট আল ফালাহ গলির ইমরান হোসেন কয়েকদিন জ্বরে ভুগছিলেন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা শেষে তার শরীরে শনাক্ত হয় করোনাভাইরাস।

চট্টগ্রামে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া এমন বিচিত্র জ্বরের কারণ কী— এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ থেকেই হচ্ছে। এই জ্বরটা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, করোনা, নন-করোনা সংক্রান্ত অন্য কারণেও হতে পারে বলে তারা অভিমত দিলেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় জানান, এবারের জ্বরে আগের মত উচ্চমাত্রার জ্বর থাকছে না। তবে নাক জ্যাম, অল্প জ্বর, সর্দির সঙ্গে কাশি হচ্ছে। তবে এ জ্বর ঋতুর বৈরিতার কারণেও হচ্ছে।

ঋতু পরিবর্তন ও ঋতু বৈরিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘ঋতু পরিবর্তন হল এক ‍ঋতু থেকে আরেক ঋতুতে পরিবর্তন হওয়া। কিন্তু মাঘ মাসের শীতে বাঘ কান্দে একটা প্রবাদ চালু আছে। কিন্তু আজ সোমবার মাঘের ৪ তারিখ, কিন্তু কতটা শীত অনুভূত হচ্ছে এখন? শীতের গরম কাপড় কতটুকু পরছি? সেভাবে তো পরা হচ্ছে না। অফিস থেকে বাসায় ফিরে হালকা টি-শার্ট পরেই থাকছি। এই ঋতুর বেসামাল চরিত্রই সবাইকে জ্বরে ভোগাচ্ছে এখন।’

তবে এসব জ্বরে করোনার মৃদু উপসর্গ থাকছে— তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়। কারণ করোনা পরীক্ষা যারা করেছে, তাদের বেশিরভাগই পজিটিভ। সোমবার গত ২৪ ঘন্টায় পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের হার হয় ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি করোনা পরীক্ষা করলে ফলাফল পজিটিভ আসার সম্ভাবনাই বেশি। করোনার মৃদু উপসর্গও সেটিই। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টায় যেমনটি ছিল, ঠিক তেমনই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে এখন। তখনও ঘরে ঘরে জ্বর ছিল। কিন্তু সেটাকে মানুষ করোনা মনে করে পরীক্ষা করতে যায়নি। এখনও তাই হচ্ছে। তবে করোনা পজিটিভের হার ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশই বুঝিয়ে দিচ্ছে জ্বরের সময় করোনা পরীক্ষা করলে করোনা পজিটিভই আসছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন ল্যাবে দুই হাজার ৮৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭৪২ জনের দেহে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়। পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের হার হয় ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ হিসাবেই দেখা যায়, ঘরে ঘরে জ্বরের মধ্যেই ২৪ ঘণ্টায় করোনা পজিটিভ রোগী আগের দিনের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগের আরপি বা রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ডা. পারিজাত বিশ্বাস জানান, ‘মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অনেকের নমুনা পরীক্ষার পর করোনার পজিটিভ আসছে। তাই জ্বর হলেই প্রখমে ফিজিশিয়ানকে দেখাতে হবে। ফিজিশিয়ানই জ্বরের উপসর্গ দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন, করোনা পরীক্ষা করতে হবে কিনা। তবে জ্বর হলেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বাসায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে পৃথক কক্ষে অবস্থান করতে হবে।’

নগরীর বেপারীপাড়া এলাকার গৃহবধু স্নিগ্ধা বেগমের জ্বর আসে তিন দিন আগে। মোড়ের একটি ফার্মেসিতে গিয়ে জ্বরের কথা বলে অ্যান্টিবায়োটিক ও প্যারাসিটামলসহ আরও কয়েকটি ওষুধ কিনে খেয়েছেন। এখন আর জ্বর নেই। তবে শরীর তার খুবই দুর্বল।

স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের কাছে আসা বেশিরভাগ রোগীর মধ্যেই মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। আবার দুর্বল শরীরে জ্বর নিয়েও অনেকে বাজারঘাটসহ জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিষয়টিকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেছেন চিকিৎসকেরা।

তবে হঠাৎ হঠাৎ জ্বরে ভোগা অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ডাক্তারের কাছে না গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগই ভাগই বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে জ্বরের কথা বলে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। অনেকে আবার ইতিমধ্যে এভাবে সুস্থও হয়ে উঠছেন। তবে এই ধরনের রোগীর খুব কম অংশই করোনা পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন।

একাধিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক বিড়ম্বনাসহ নমুনা পরীক্ষায় জটিলতা ও আস্থাহীনতার কারণে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হলেও করোনা পরীক্ষায় আগ্রহী নন তারা।

জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় সবারই ধারণা— করোনা হোক আর সাধারণ জ্বর হোক, তা সাধারণ চিকিৎসাতেই ভালো হয়ে যাবে। এছাড়া এর আগে নমুনা দেওয়ার পর অনেকেই ৮ থেকে ১০ দিন বা তারও বেশি সময় পর পজিটিভ রিপোর্ট পেয়েছেন। কিন্তু ততো দিনে তারা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করলেও পজিটিভ হওয়ার কারণে পরিবারসহ লকডাউনে যেতে হয় তাদের। তাদের কেউ কেউ সামাজিক হেনস্তার শিকারও হন। এ কারণে জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই করোনা পরীক্ষায় আগ্রহ কম।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!