চটকদার মোড়কে ভেজালে ভরা জাসমির ও তীর সয়াবিন তেল

দুই মালিকের বিরুদ্ধে বিএসটিআইয়ের মামলা

চটকদার বিজ্ঞাপন ও মোড়কের আড়ালে ‘তীর’ ও ‘জাসমির’ ব্যান্ডের সয়াবিন তেল পুরোটাই ভেজালে ভরা। চট্টগ্রামের দুটি কারখানায় নিম্নমানের এই তেল উৎপাদন করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশজুড়ে। ভয়ংকর এ জালিয়াতি ধরা পড়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন বা বিএসটিআইয়ের সার্ভিল্যান্স অভিযানে। সরকারি এই সংস্থাটির সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, মোটামুটি মানসম্মত সয়াবিন তেলে ন্যূনতম যেসব উপাদান থাকার কথা, তার কিছুই নেই এই দুটি ব্র্যান্ডের সয়াবিনে। ভেজাল সয়াবিন তেলের আলামত পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আদালতে।

চট্টগ্রাম পিউর ফুড কোর্টে হাজির হতে আসামিদের প্রতি সমনও জারি করেছেন আদালত। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও পিউর ফুড কোর্টের বিচারক আবু ছালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে মামলা দুটি বিচারাধীন রয়েছে।

অনুসন্ধানের বিস্তারিত জানিয়ে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, অভিযুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানের বাজারজাত করা সয়াবিনে ভিটামিন ‘এ’ এর স্ট্যান্ডার্ড মান নির্ধারণ করা আছে ১৫ মিলিগ্রাম থেকে ৩০ মিলিগ্রাম। কিন্তু বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় জাসমির ব্যান্ডের সয়াবিনে ভিটামিন ‘এ’র উপাদান পাওয়া গেছে মাত্র ৪ দশমিক ২৭ মিলিগ্রাম! অন্যদিকে তীর ব্যান্ডের সয়াবিনে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া গেছে আরও কম— মাত্র ৩ দশমিক ১৬ এমজি। যা বিএসটিআই আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

চটকদার মোড়কে ভেজালে ভরা জাসমির ও তীর সয়াবিন তেল 1

বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক গাজী মো. নজরুল ইসলাম (কেমিক্যাল), সহকারী পরিচালক শেখ মাসুম বিল্লাহ (কেমিক্যাল), পরিদর্শক শেখ আশিক আহমদ (কেমিক্যাল) ও পরিদর্শক দেবাশীষ তালুকদারের (কেমিক্যাল) তত্ত্বাবধানে সয়াবিন তেলের এই দুটি ব্র্যান্ডের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রাসায়নিক প্রতিবেদনে ভেজাল সয়াবিন বাজারজাত করার চিত্র উঠে আসে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত দুটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর গত ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতের আওতাধীন চট্টগ্রাম পিউর ফুড কোর্টে বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হয়।

আসামি কারা, অপরাধ কী
‘জাসমির’ ব্রান্ড সয়াবিন তেলের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাসমির সুপার অয়েল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমদ রতন। তিনি নূরজাহান গ্রুপেরও চেয়ারম্যান। অন্যদিকে ‘তীর’ ব্রান্ড সয়াবিন তেলের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান। তিনি সিটি গ্রুপেরও চেয়ারম্যান। দুজনকে পৃথক পৃথক মামলায় আসামি করা হয়েছে। দুটি মামলারই বাদি বিএসটিআইয়ের পরিদর্শক রাজীব দাশগুপ্ত। মামলার অভিযোগনামায় তাদের বিরুদ্ধে ‘সরকারি আইনকে অবজ্ঞা করে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন এ সংযোজন না করে ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল ও ফর্টিফাইড পাম অলিন পণ্য বিক্রয় ও বিতরণ এবং বাজারজাত অব্যাহত রাখায় অপরাধ আমলে নিয়ে শাস্তির সুপারিশ করা হয়।’

যেখানে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল তেল
সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন ‘তীর’ ব্যান্ডের সয়াবিন তেল উৎপাদন হচ্ছে চট্টগ্রামে। নগরীর উত্তর পতেঙ্গায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তেল উৎপাদন ও বোতলজাত করার কারখানা। সেখান থেকেই ভেজাল সয়াবিন বাজারজাত করা হচ্ছে। অন্যদিকে জাসমির ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের উৎপাদন হচ্ছে নগরীর ৫০/এ ফৌজদারহাট শিল্প এলাকার কারখানায়। পাহাড়তলীর সাগরিকা রোডে অবস্থিত কারখানা থেকেই ওই সয়াবিন বাজারজাত করা হচ্ছে।

ভেজাল তেল বিক্রয় ও বাজারজাতে অপরাধ ও শাস্তি
দুটি মামলায় আনা অভিযোগে বলা হয়েছে ভেজাল পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) আইন, ২০১৮ এর ১৫ ও ২১ ধারার পরিপন্থী কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়, যা উক্ত আইনের ২৭ ও ২৯ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ আইন, ২০১৩ এর ৪(১) ও ৪(২) ধারার পরিপন্থী কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়। যা উক্ত আইনের ১৬(১) ও ১৬(২) ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এভাবে তীর ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুর রহমান এবং জাসমির ব্যান্ডের মেসার্স জাসমির সুপার অয়েল লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহির আহাম্মদ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাই তাদের পৃথক দুটি মামলায় আসামি করেছে বিএসটিআই।

বিএসটিআইয়ের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আশরাফ উদ্দিন খন্দকার রনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তীর ও জাসমির ব্যান্ডের সয়াবিন তেলে যেসব উপাদান থাকার কথা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সে সমস্ত উপাদান পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠান দুটি ভেজাল সয়াবিন বিক্রয়, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বাজারজাত করে বিএসটিআই আইনে অপরাধ করেছে। বিএসটিআই মামলা দায়েরের পর দুটি প্রতিষ্ঠানের এমডিকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’

বিএসটিআইয়ের এই আইনজীবী জানান, ‘দুই প্রতিষ্ঠানের এমডির বিরুদ্ধে বিএসটিআই আইনের ২৭ ধারায় আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের ২ বছর কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা এবং ২৯ ধারায় অভিযোগ প্রমাণ হলে ৪ বছর কারাদন্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা দেওয়ার বিধান রয়েছে। দুটি ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৬ বছর কারাদন্ড ও ৩ লাখ টাকা জরিমানা গুণতে হবে ভেজাল সয়াবিন বাজারজাতকারীদের।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আইনের বাধ্যবাধকতা না মানলে এটা অবশ্যই গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা। ভোক্তাকে গোপনে ঠকিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের কঠিন শাস্তি হলে তাহলে ভোক্তার সঙ্গে কেউ প্রতারণা করার সাহস দেখাবে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!