চকবাজারের হোস্টেলগুলো ছাত্রীদের কাছে বিকাশে চায় ‘ফুল পেমেন্ট’

হোস্টেল বন্ধ, ছাত্রীরা বাড়িতে— তবু ৩ মাসের ভাড়া চায় মালিকরা

আঁচল, প্রশান্তি, কন্টিনেন্টাল, মাতৃছায়া, মাতৃনিলয়, প্যারেন্টস কেয়ার, বেগম রোকেয়া, চট্টগ্রাম হোস্টেল— সুন্দর এ নামগুলো হল চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকার বিভিন্ন ছাত্রী হোস্টেলের। প্রতি বছর অন্তত হাজারখানেক শিক্ষার্থী নগরের বিভিন্ন ছাত্রী হোস্টেলে ওঠেন। যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব হোস্টেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট পায় না, তাদের শেষ আশ্রয় হয় এ প্রাইভেট হোস্টেলগুলোতে। সেখানে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। পড়াশোনা বা চাকরির প্রয়োজনে নগরের এসব হোস্টেলে থাকেন তারা।

চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারের আধা কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছোট-বড় মিলে অন্তত ১৫টি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। এতে থাকেন ৫ হাজারেরও বেশি ছাত্রী ও চাকরিজীবী নারী। এসব হোস্টেল মানের তুলনায় অনেক বেশি চার্জ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, করোনার এ লকডাউনে হোস্টেলে থাকা ছাত্রীরা যার যার বাড়ি চলে গেলেও হোস্টেলের ভাড়া ও খাবার বাবদ অর্থ পরিশোধের চাপ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বিকাশের মাধ্যমে হোস্টেলের ভাড়া পরিশোধ করার জন্য মেসেজ পাঠালে শিক্ষার্থীরা করোনা পরিস্থিতিতে আংশিক ভাড়া দেওয়ার কথা জানালে সেটিও মানতে নারাজ হোস্টেলগুলো। কোন শিক্ষার্থী সিট ছেড়ে দেবেন বলে জানালে তাকেও হয়রানি করা হচ্ছে।

সিট ছেড়ে দেবেন জানালেও অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে হয়রানি করা হচ্ছে তাদেরও। এক ছাত্রী মালামাল ফেরত নিতে চাইলে অতিরিক্ত একমাসের ভাড়াও দাবি করে বসে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিভিন্ন হোস্টেলের কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা ছাত্রীদের সাথে যথেষ্টই মানবিক আচরণ করেছে। এ সময়ে খাবারের বিল বাকি রেখে শুধু সিটভাড়া পরিশোধ করতেই বলা হয়েছে। সিট ভাড়া পরিশোধের জন্য মেসেজ পাঠানো হয়েছে ছাত্রীদের নম্বরে।

চকবাজারের আঁচল হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা শফিক নামের একজন জানিয়েছেন, ‘দেখুন লকডাউনে তাদের খাবারটা ছাড়া বাকি সব খরচ আমাদের বহন করতে হচ্ছে। তবুও এ করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রীদের প্রতি আমরা মানবিক হয়েছি। তাদের সিট ছাড়া বা টাকা দেওয়ার ব্যপারেও কোনরকম জোর-জবরদস্তি করা হয়নি। আমরা মাসিক খরচে প্রায় ২০০০ টাকার মত ছাড় দিয়েছি। কেউ সিট ছাড়তে চাইলে তাদেরও বলেছি শুধু ফোন করে জানালেই হবে। তবুও কেউ আপনাদের অভিযোগ করলে সেটা নিতান্তই ভুল তথ্য।’

কন্টিনেন্টালে থাকেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ুয়া জিমি সুলতানা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি কুমিল্লায়। লকডাউনে তিন মাস আগে বাড়ি চলে এসেছি। এখন বিকাশে টাকা পরিশোধের মেসেজ পাঠিয়েছে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। তিনমাস ধরে সেখানে থাকি না। খাবারেরও খরচ নেই। বিদ্যুৎ বিলও নেই। আমরা কয়েকজন ছাত্রী মিলে অনুরোধ করেছিলাম হোস্টেল ফি ৪০ শতাংশ কম রাখতে। আমরা বলেছি স্যার আপনিও একজন বাবা। আমাদের সবার বাবা মধ্যবিত্ত। ভাইবোনের লেখাপড়া, আমার সেমিস্টার ফি ছাড়াও এ পরিস্থিতিতে সবাই অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থায় আছি। আমাদের পরিবার কিভাবে এমন পরিস্থিতিতে পুরো টাকা দেবে? কিন্তু তিনি সেটি মেনে নেননি। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে এসে সিট ছেড়ে দেব সে অবস্থাও নেই। আমাদের হোস্টেলে তেঁতুলিয়ার মেয়েও আছে।’

জিমি বলেন, ‘বিভিন্ন হোস্টেলে থাকা আমরা বেশ কয়েকজন মিলে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের বিষয়টি বিবেচনা করতে। তারা তো মানবিক হলেনই না, বরং খুব অন্যায় আচরণ করছেন ছাত্রীদের সাথে। একজন ছাত্রী সিট ছেড়ে দেবে জানালে তাকে তার মালপত্র ফেরত দিতে অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। সিট ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়ে অন্য একজন ছাত্রী মালামাল আনতে কয়েকদিন সময় চাইলে তাকে বলা হয় ইমিডিয়েট নাকি সিটটি অন্য কাউকে দেবে। তাই মালামাল সরাতে সময় দেওয়া সম্ভব না। অথচ আমরা সবাই জানি হোস্টেলে এখন কেউ থাকে না। এমনকি হোস্টেল কর্তৃপক্ষের কেউও না।’

জিমি প্রতিবেদককে বলেন, ‘হোস্টেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও তেঁতুলিয়ার মেয়েও আছে। অনেকের বাড়ি অনেক দূরে। এখন এসে সিট ছেড়ে দেওয়া বা বিশাল এমাউন্টের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব না। অনেকের বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী— যাদের এখন আয় নেই বললেই চলে। প্লিজ আমাদের কেউ সাহায্য করুন।’

কক্সবাজারের টেকনাফের মেয়ে পূজা চক্রবর্তী (ছদ্মনাম) চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সুবাদে থাকতেন নগরীর আঁচল ছাত্রীনিবাসে। তিনি বলেন, ‘আপু, কক্সবাজার তো এখন লকডাউন। আমি সিট ছেড়ে দেব বলেছি। এখন এখান থেকে গিয়ে কিভাবে মালামাল নিতে পারব? সেটি জানালে তারা বলে সিট অন্য কাউকে ভাড়া দেওয়া হবে। এখনই সিট ছাড়তে হবে। আমি অনেক কষ্ট করে এক খালাতো বোনকে পাঠিয়েছি আমার মালামাল আনতে। কিন্তু ওরা অল্প টাকাও ছাড় দিতে নারাজ। খুব বিপদে পড়ে গেছি।’

পূজা আরও বলেন, ‘আমি স্যারকে বলেছি—আমরা জানি স্যার আপনারও ফ্যামিলি আছে। আমরা না থাকলেও হোস্টেল বিল্ডিংয়ের ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। তাই মওকুফ চাইনি। শুধু বলেছি টাকার একটা অংশ ছাড় দিতে। এতে আপনার লাভ একটু কম হবে। কিন্তু ওই টাকায় হোস্টেলের মেইনটেনেন্স ডিউ পরিশোধ করতে পারবেন। আমাদের পরিবারের অবস্থাও একটু ভাবুন। এ সময়ে টাকা পরিশোধ করা সম্ভব না।’

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ুয়া এক ছাত্রী জানান, ‘হোস্টেল কর্তৃপক্ষ টাকায় ছাড় দিচ্ছে কেবল খাবার বাবদ ৭৫০ টাকা। ভাড়া সিটভেদে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ নিয়ে কোন নজরদারি না থাকায় লকডাউনেও আমাদের হয়রানি হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন অভিভাবক বলেন, ‘১৮ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সব শিক্ষার্থী যার যার বাড়ি চলে যায়। যতটুকু জেনেছি হোস্টেল পরিচালনার সাথে যুক্ত স্টাফ-বাবুর্চিরাও করোনা ঝুঁকির কারণে যার যার বাড়ি চলে যায়। কিন্তু এই করোনা মহামারিতেও হোস্টেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের পরিবারের কথা বিন্দুমাত্র পরোয়া করছে না। কোন সমঝোতায় না এসে একটা মনগড়া ফি নির্ধারণ করে দিলো (মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসের)। এটি পরিবারের পক্ষে পরিশোধ করা অনেকটা দুঃসাধ্য।’

তিনি বলেন, ‘হোস্টেল পুরোপুরি বন্ধ। সে হিসেবে তেমন বিদ্যুৎ বিল আসবে না। হোস্টেল পরিচালনায় নিয়োজিত স্টাফ-বাবুর্চি-গার্ডও খুব বেশি নয়। ছাত্রীদের কাছে ১০০০ টাকা করে নিলেও তাদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব। তারাও পরিস্থিতির শিকার। অথচ হোস্টেল চাইছে ৪০০০-৫০০০ টাকা। অথচ ৩ মাস শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাসায়ই আছে। করোনার এই ভয়াবহতায় এরা তাদের ব্যবসা রমরমা করার চেষ্টাতেই আছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘এমন কিছু অভিযোগের কথা শুনেছি। শিক্ষার্থীদের বাসা ভাড়া ও হোস্টেলের ভাড়া নিয়ে সমস্যা হলে ভুক্তভোগীরা যোগাযোগ করলে এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ইতিমধ্যেই সবাইকে বলেছি যে সারা বছর ব্যবসা করেছেন। এ সময়ে অমানবিক হবেন না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!