ঘুরেফিরে পাঁচজনের নাম চবির যৌন নিপীড়নে, অংক সাজাতে ব্যস্ত প্রশাসন

রুবেলের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল ভুক্তভোগী ছাত্রীর

কয়েকদিন ধরে মিছিল-স্লোগানে উত্তাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রীর শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে ফুঁসে উঠেছে চবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনা নিয়ে একের পর এক বেরিয়ে আসছে চমকজাগানো সব তথ্য। কোনো এক অজানা ভয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা। খোদ ওই ছাত্রীকেই রীতিমতো ‘নজরবন্দি’ রেখে কারও সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে না চবি প্রশাসন। তবে আন্দোলনকারীরা তো বটেই, মোটামুটি সব পক্ষেরই সন্দেহ পাঁচ যুবকের দিকে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, মূল এই অপরাধীদের বাঁচাতে কোনো কোনো মহল মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সহপাঠীর শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সহপাঠীর শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

১৭ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী তার বন্ধুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন চত্বর থেকে মূল ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলেন। যে রাস্তা দিয়ে তারা হেঁটে যাচ্ছিলেন সেটা বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকা হয়ে কিছুটা ঘুরে গিয়ে মূল ক্যাম্পাসে মেশে। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে আসা অন্তত ৫ জন ছেলে তাদের দুজনের পথ আটকায়। একপর্যায়ে ওই ছাত্রীর সাথে থাকা ছেলেটিকে তারা মারধর শুরু করে। ওই সময় তাদের কাছে থাকা ৩ হাজার ৭০০ টাকা টাকা এবং দুজনের দুটি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে নেয় ওই ছেলেরা। ছিনতাই করার পর বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনের দিকের অন্ধকার রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ওই ছাত্রীর কাপড় খুলে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে অন্তত ৫ জনের ওই দুর্বৃত্তদল। এ সময় ওই ছাত্রীকে গাছের সাথে বেঁধে যৌন হয়রানিও করা হয়। এরপর তাকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয় যে, সে যদি এই ঘটনা অন্য কোথাও বলে তাহলে সেই ভিডিও প্রকাশ করে দেওয়া হবে। পরে মোটরসাইকেলে করে ওই ছেলেরা সরে পড়ে।

সহপাঠীর শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সহপাঠীর শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ঘটনায় জড়িত কারা?

ভুক্তভোগী ছাড়াও শিক্ষার্থীরা বলছেন, যৌন নিপীড়নের এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত অন্তত পাঁচ যুবক। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, কমপক্ষে ৫ জন দুটি মোটরসাইকেলে করে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ঘটনাস্থলে যান। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেল বান্টি নামের এক শিক্ষার্থীর— এমন দাবি করছেন কেউ কেউ। যে পাঁচজন যৌন নিপীড়নে অংশ নেন, তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন হিসেবে হৃদয়, আজিম ও সিয়াম নামে তিন ছাত্রের কথা আলোচনায় আসছে। সূত্রের দাবি, এই তিনজনকে ইতিমধ্যে ঘটনার শিকার ছাত্রী শনাক্তও করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে এর সত্যতা যাচাই করা না গেলেও এদের প্রত্যেকেই চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের ঘনিষ্ঠজন বলে জানা গেছে। এদের সকলেই আবার রুবেলের নেতৃত্বাধীন ক্যাম্পাসভিত্তিক সিএফসি গ্রুপের কর্মী।

এদিকে রুবেলের পক্ষের নেতারা দাবি করছেন, ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে তাদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে তাদের একটি ‘সিন্ডিকেট’ আছে— যেখানে পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাই একজোট। এদের মধ্যে আজিম ছাড়া বাকি যে চারজন নাম শোনা যাচ্ছে, তারা চবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারী এবং ক্যাম্পাসভিত্তিক ভিএক্স গ্রুপের কর্মী। দাবি করা হচ্ছে, এই চারজন হলেন আফসার, রাকিব, শাওন ও সাইফুল।

রহস্যময় তৎপরতা প্রশাসনের

চবি ক্যাম্পাসে একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা সচল থাকলেও অভিযুক্তদের এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেনি চবি প্রশাসন। রোববারের ঘটনার একদিন পর মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) চবির প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। অভিযোগ পাওয়ার পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে চবি প্রশাসন। এই কমিটির প্রধান প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া। যদিও চবি প্রশাসন বলছে, অপরাধীদের শনাক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপন করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে ওই ছবিগুলো যৌন হয়রানির শিকার সেই ছাত্রীকেও দেখানো হচ্ছে যাতে তিনি অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারেন।

তবে তারা এও জানাচ্ছেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকার যে স্থানে ঘটনা ঘটেছে সেখানে কোনো ক্যামেরা ছিল না। তবে ঘটনার আশেপাশের দুই ঘণ্টা সময়ে ওই এলাকায় প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথে থাকা ক্যামেরাগুলোর ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সবাই জানে, কিন্তু মুখে খোলে না কেউ

নিজেদের সহপাঠীর শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে বুধবার (২০ জুলাই) রাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয় চবির ছাত্রী হলগুলোতে। এছাড়া বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) সারাদিন বিক্ষিপ্তভাবে মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কিন্তু অপরাধী কারা— এ নিয়ে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।

এ নিয়ে কেন এতো রাখঢাক— এমন প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চবির এক সহযোগী অধ্যাপক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঘটনা কী হয়েছে তা সকলেই জানে। কারা জড়িত থাকতে পারে তাও হয়তো অনেকে ধারণা করছেন। যেহেতু এই ঘটনার পিছনে একটি বৃহৎ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত, সেহেতু কেউ যেচে নিজের বিপদ টানতে চাইছেন না।’

চবির সাম্প্রতিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থীও একই সুরে বললেন, ‘আমি যদি এখন প্রকাশ্যে ওদের নামে কথা বলি, তাহলে আমাকে কি আর এই ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেবে? আমাকে হলে থাকতে দেবে? আমার তো লেখাপড়া শেষ করতে হবে। আমরা সবাই কম বেশি জানি কারা করেছে, কে কে জড়িত। কিন্তু তারপরও কেউ ভয়ে বলবে না।

কী ছিল ঘটনার পেছনে?

ঘটনার পেছনের ঘটনা নিয়ে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ দাবি করছেন, ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী সঙ্গীত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তিনি চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের সহযোগিতায় একটি হলে সিট পান। সেই সুবাদে রুবেলের সাথে প্রায়ই কথা হতো ওই ছাত্রীর। রুবেল প্রায়ই তাকে দেখা করার জন্য চাপ দিতেন। কিন্তু মেয়েটি রুবেলের এমন কাণ্ডে বিরক্ত হয়ে রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন।

দাবি করা হচ্ছে, ঘটনার দিন মেয়েটির এক বন্ধু চীন থেকে আসলে তারা ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় রাতে দেখা করতে যান। এ খবর পৌঁছে যায় রুবেলের কাছে। পরে নেতার অপমানের শোধ নিতেই গাছের সাথে বেঁধে উলঙ্গ করে ওই ছাত্রীর ভিডিও ধারণ করা হয়। দুর্বৃত্তরা ওই ছাত্রীর বন্ধুটিকেও আহত করে তারা মোবাইল ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

তবে ভুক্তভোগী ছাত্রীটির সঙ্গে যে ছাত্রলীগ সভাপতি রুবেলের পূর্ব পরিচয় ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় একাধিক মাধ্যমে। রুবেল নিজের ফেসবুকেই লিখেছেন মেয়েটি ঘটনার শিকার হওয়ার পর সর্বপ্রথম তাকেই ফোন করে ঘটনাটি জানান। রুবেলই প্রথম মেয়েটিকে নিয়ে চবি প্রশাসনের দ্বারস্থ হন।

কিন্তু রুবেলের এমন দাবিকে ডাহা মিথ্যা বলে ক্ষোভ ঝেড়েছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই। তারা বলেন, চবি প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে ভুক্তভোগী ওই মেয়েকে রুবেলই বাঁধা দেন। ওই সময় রুবেল বলেন, যারা এই কাজ করেছে তাদের সবাইকে তিনি চেনেন এবং বিষয়টি সমাধান করে দেবেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, যেহেতু অভিযুক্তরা সভাপতি রুবেলের সহযোগী, তাই বিষয়টি বড় হলে নিজের জন্য বিপদ হতে পারে ভেবে তিনি প্রথমে ভুক্তভোগীকে চবি প্রশাসনের সামনে না এনে নিজেই সমাধান করতে চেয়েছেন।

কিন্তু সেই সমাধানের চেষ্টাতেই বিপদে পড়েছেন রুবেল। এরই মধ্যে মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) মধ্যরাতে দলীয় ‘শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে লিপ্ত’ থাকার অভিযোগে শোকজের নোটিশ নেওয়া হয় তাকে। তিন দিনের সময় দিয়ে রুবেলের কাছ থেকে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া বলা হয়, কেন তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তবে নোটিশের প্রায় ৪৮ ঘন্টা পার হলেও চবি ছাত্রলীগের কোনো নেতাই রুবেলের বিশৃঙ্খল কাজের হদিস পাননি।

এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। আর সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুও এখন পর্যন্ত জানেন না ঠিক কী কারণে তার কমিটির সভাপতিকে শোকজের নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তবে জানা গেছে, নোটিশ দেওয়ার ‘কারণ’ খুঁজতে বর্তমানে ঢাকায় তদবিরে ব্যস্ত চবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, মূলত নারীঘটিত ব্যাপার ও সর্বশেষ চবি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার কারণেই রুবেলের ওপর ক্ষেপেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।

সেই ছাত্রী ‘নজরবন্দি’

এদিকে জানা গেছে, ঘটনার পরপরই ভুক্তভোগী ছাত্রীটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষকের বাসায় রাখা হয়েছে। সেখানে ছাত্রীটিকে মামলা না করার জন্য বারেবারেই চাপ দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের পাশাপাশি চবি প্রশাসনের একটি পক্ষও ঘটনাটিকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বিবস্ত্র করে ভিডিও করার ঘটনাটিকে নিতান্তই ‘মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা’ বলেও জবানবন্দি নিতে চাপ দেয় ওই ছাত্রীকে— এমনও জানা গেছে চবি প্রশাসনেরই একটি সূত্রে। এছাড়া ‘নিরাপত্তা’র দোহাই দিয়ে ওই ছাত্রীকে কারও সঙ্গে দেখাও করতে দিচ্ছে না চবি প্রশাসন।

এদিকে হাটহাজারী থানায় ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী একটি মামলা করলেও পুলিশও মামলার বিষয়বস্তু বা অভিযুক্তদের ব্যাপারে কোনো তথ্য গণমাধ্যমকে দিতে চাইছে না। বৃহস্পতিবার রাতে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে শুধু বলেছেন, ‘চবির এক শিক্ষার্থী থানায় মামলা করেছে। মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!