ঘরে-বাইরে অভিযোগে জর্জরিত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের ৭ বছর

স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে

সম্মেলন ছাড়াই এক বছরের জন্য ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এক বছরের জন্য দেওয়া সেই কমিটি গত ৭ বছর ধরে বহাল আছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এই কমিটির বিরুদ্ধে নগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। গঠনতন্ত্রের চরম লঙ্ঘন ছাড়াও এই কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও। পাশাপাশি রয়েছে তৃণমূলে রাজনীতি স্তিমিত করে দেওয়ার অভিযোগ। গত কয়েক বছর ধরেই লাগাতার আন্দোলনও চলছে এই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি দেওয়ার দাবিতে।

মেয়াদের পরও ৬ বছরের বেশি সময় দায়িত্বে থেকে নগরের ১৪ থানা, ৪১ ওয়ার্ড ও কলেজ ইউনিটগুলোর বেশিরভাগ ইউনিটেই কমিটি দিতে পারেনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরের আওতাধীন পাঁচটি থানা ছাত্রলীগের কমিটি ও একটি কলেজ এবং হাতেগোনা কয়েকটি ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করতে পেরেছে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ। কমিটি ঘোষণা করা থানাগুলো হলো চান্দগাঁও, ডবলমুরিং, আকবরশাহ, বন্দর ও পতেঙ্গা। এছাড়া ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি।

এসব কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রলীগের একটি পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনও করে। এসব কমিটিতে অস্ত্রধারী, অছাত্র, বিএনপি পরিবারের সদস্যরা পদ পেয়েছে দাবি করে কমিটি বাতিল করে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের দাবি জানায় তারা। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তদন্ত কমিটিও করে। কিন্তু তদন্ত কমিটির কী সুপারিশ ছিল বা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক

এছাড়াও ঘরে-বাইরে নানান অভিযোগে জর্জরিত এই কমিটির বিরুদ্ধে মোটা দাগে যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠেছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২৯১ সদস্যের কমিটিতে ৫৬ জন বিবাহিত ও ১৬২ জন অছাত্র।

গত ৭ বছরে বেশিরভাগ সময়েই কমিটি বাতিলের দাবিতে মাঠে ময়দানে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে নগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শুরুতে শুধু আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা এই দাবিতে আন্দোলন করে আসলেও এক পর্যায়ে এমন দাবি ওঠে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্য থেকেও।

কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরতদের একজন কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয় উপ-সম্পাদক নাছির উদ্দীন কুতুবী। আজম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই ছাত্রলীগ নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগর ছাত্রলীগের দৃশ্যমান কোন কর্মকাণ্ড নেই। বরং দৃশ্যমান অনেক অপকর্ম আছে। কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকা এবং বিভিন্ন সময়ে কমিটির শীর্ষ নেতারা বিতর্কে জড়ানোয় সংগঠনের ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। তাছাড়া এই কমিটির হাত ধরে সাংগঠনিক কার্যক্রম যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তার হাত থেকে সংগঠকে রক্ষা করার তাগিদেই আমরা আন্দোলন করছি দীর্ঘদিন ধরে।’

তিনি বলেন, ‘এই কমিটির আনুগত্যের জায়গাতেও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দীর্ঘ ৭ বছরে তারা কখনোই মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকে না, সহযোগিতাও করে না।’

নাছির উদ্দীন কুতুবী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এসব সংকট নিয়ে কথা বলছি। মাঠে আন্দোলন করছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণ সহকারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে স্মারকলিপি দিয়েছি। মাঝে করোনার কারণে আমাদের মাঠের আন্দোলন সাময়িক স্থগিত থাকলেও আমরা আমাদের কথাগুলো কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে জানাচ্ছি। সংগঠনের স্বার্থেই নতুন নেতৃত্ব দরকার। এভাবে একটা সংগঠন চলতে পারে না।’

ভিপি ওয়াসিম উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর ছাত্রলীগ নেতা সৈকত দাশ বলেন, ‘৭ বছরেও এই কমিটির নেতৃবৃন্দ ইউনিট পর্যায়ে কমিটি দিতে পারেনি। এটি যে কত বড় সংকট— সেটি তো বলার অপেক্ষা রাখেনা। কত হাজার হাজার নেতাকর্মী তাদের প্রাপ্য মূল্যায়ন পেল না। তাছাড়া এই কমিটির বেশিরভাগ নেতাই অছাত্র ও বিবাহিত। এতে করে পুরো নগরেই ছাত্রলীগের রাজনীতি অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে। এসব কারণে আমরা কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেছি। বঞ্চিতদের তালিকা আরও দীর্ঘ হওয়ার আগেই নগর ছাত্রলীগের সম্মেলন করা উচিত বলে আমরা মনে করি।’

নগর ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে পরমত অসহিষ্ণুতার অভিযোগ এনে সৈকত দাশ আরও বলেন, ‘উনারা অনেকদিন কোনো ইউনিটে কোনরকম রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন না। উনাদের এসব নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কিংবা সম্মেলনের দাবিতে কথা বললেই অনেককে উনারা উনাদের ফেসবুক আইডি থেকে আনফ্রেন্ড অথবা ব্লক করেছেন। এই যখন মানসিকতা তখন উনাদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের বিকাশ আসলে কিভাবে সম্ভব?’

এসব বিষয়ে কথা বলতে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের সাথে যোগাযোগের জন্য দুই দিন ধরে কয়েক দফায় চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি।

এদিকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা নুরুল আজিম রনির সাথে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে এখন আমি কথা বলি না। তবে এটুকু বলতে পারি তাদের কার্যক্রম সন্তোষজনক না।’

প্রসঙ্গত ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে নগর শাখার ২৪ জনের সম্মেলনবিহীন আংশিক কমিটি ঘোষণা ও অক্টোবরে পরবর্তীতে কেন্দ্র থেকে ২৯১ জনের ‘গঠনতন্ত্র বিরোধী’ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।

২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল একটি ঘটনার জের ধরে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি পদত্যাগ করলে জাকারিয়া দস্তগীরকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ওই কমিটিতে ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাকারিয়া দস্তগীর।

গত ১৯ জুলাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!