গ্রামের গাড়ি দমনে শহুরে পুলিশের ‘অ্যাকশন’, চট্টগ্রামে লাখো যাত্রীর দুর্ভোগ

মঙ্গলবার দুপুর ১টা। চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাট এলাকা। শহরমুখী কয়েকশ মানুষের ভিড়। সবাই বোয়ালখালী উপজেলার মানুষ। প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কালুরঘাট রেল সেতু হেটে পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা। কিন্তু এ পাড়ে এসে পড়েছেন বিপাকে। কারণ এই স্থানে নেই কোনো বাস কাউন্টার। নেই অন্যকোনো গণপরিবহনও। নগরীতে চলাচলকারী কিছু সিএনজি অটোরিকশা দেখা গেছে সেখানে। পর্যাপ্ত গগণপরিবহন না থাকার সুযোগে ৬ কিলোমিটার দূরের বহদ্দারহাট যেতেই তারা দাম হাঁকছে ২০০ টাকা!

বোয়ালখালী থেকে গ্রামে চলাচলের অনুমতি পাওয়া কোনো সিএনজি অটোরিকশা কালুরঘাট সেতু পার হতে দিচ্ছে না সিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগ। ফলে বোয়ালখালীর হাজার হাজার শহরমুখী যাত্রী পড়েছে এমন দুর্ভোগে। গত এক মাস ধরেই এই দুর্ভোগ তাদের সঙ্গী।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে বোয়ালখালী ও কাপ্তাই সড়কে প্রধান গণপরিবহন সিএনজি অটোরিকশা। বিআরটিএ’র নীতিমালা অনুযায়ী এসব গাড়ির নগরীতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই পুলিশের বাধায় গাড়িগুলো প্রবেশ করতে পারছে না শহরের সীমানা এলাকায়ও। অথচ বছরের পর বছর ধরে নগরীর চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তামাথা এলাকায় জেলা ও নগরীর সীমানা মোড়ে এসব গাড়ি এসে দাঁড়াতো।

গত এক মাস ধরে চট্টগ্রাম থেকে বোয়ালখালী ও কাপ্তাই সড়কে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশাকে কাপ্তাই রাস্তামাথা এলাকায় আসতে না দেওয়ায় চরমে দূর্ভোগে পড়েছে ওই এলাকার প্রায় দুই লাখ মানুষ। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, উত্তর রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাই উপজেলার থেকে সিএনজি অটোরিকশায় চড়েই কেবল নগরীতে আসতে পারে যাত্রীরা। ওই সড়কে অন্যকোনো গণপরিবহন নেই। কাপ্তাই রাস্তামাথা এলাকায় নেমে যাত্রীরা মেট্রো সার্ভিসের বাসে চড়ে নগরীতে তাদের গন্তব্যে যেতেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে পুলিশের বাধায় এই গাড়িগুলো রাস্তামাথা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী থানার সীমানায় ধুপপোল এলাকায় এসে থামছে। মাঝে এই দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হিমশিম খাচ্ছে যাত্রীরা। সুযোগ বুঝে ধুপপুল থেকে রাস্তামাথা কিংবা বহদ্দারহাট পর্যন্ত নগরীতে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া হাঁকাচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা।

অন্যদিকে বোয়ালখালী থেকে সিএনজি অটোরিকশাগুলোকে কর্ণফুলী নদী পার হতে দিচ্ছে না পুলিশ। বিআরটিএ’র আইন প্রয়োগে নেমে পুলিশের এই বাধা কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে বোয়ালখালীর হাজার হাজার মানুষের জন্য। কারণ কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট সেতুটি প্রায় এক কিলোমিটার। এই রেল সেতু হেটেই পার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। আবার সেতু পার হয়ে নগরীতে প্রবেশ করলেও সেখানে নেই কোনো গণপরিবহন। কয়েকটি বাস মাঝেমধ্যে সেখান থেকে যাত্রী নিলেও মুলত তিন কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই রাস্তামাথা এলাকাতে মেট্রো প্রভাতী, সোনার বাংলাসহ বিভিন্ন মেট্রো সার্ভিসের বাসগুলোর কাউন্টার। আবার বোয়ালখালীতে কোনো সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন না থাকায় কাপ্তাই রাস্তামাথা ও বাহির সিগনাল এলাকাতেই আসতে হয় বোয়ালখালীর সিএনজি অটোরিকশাগুলোকে। বছরের পর বছর ধরে বোয়ালখালীর সিএনজি অটোরিকশাগুলো রাস্তামাথা এলাকাতে এসেই থামছে। হঠাৎ করে পুলিশ আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়ায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

উল্লেখ্য, বিআরটিসির চারটি নতুন বাস ছাড়া চট্টগ্রাম-বোয়ালখালী রুটে নেই কোনো বাস সার্ভিস বা গণপরিবহন। এই চারটি বাসও অনিয়মিত। সিএনজি অটোরিকশা ও টেম্পুই এই এলাকার যাত্রীদের একমাত্র ভরসা।

কাপ্তাই রাস্তা মাথা এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান পারভেজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সীমানা এলাকায় আইনের প্রয়োগ শিথিল করতে হয়। কিন্তু গ্রাম থেকে গাড়ি শহরের সীমানাতে ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। অথচ বোয়ালখালীর গ্রামের গাড়িগুলোকে গ্যাস নিতে হয় নগরীর সীমানা এলাকা এসেই। এছাড়া কালুরঘাট সেতুর বোয়ালখালী প্রান্তের যেখানে গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা এসে থামছে সেখান থেকে শহরে যাওয়ার কোনো গণপরিবহণ নেই। পায়ে হেটে এক কিলোমিটার ব্রীজ ঝুঁকি নিতে পার হয়েও রেহাই নেই। কারণ ব্রীজ পার হওয়ার পর শহরমুখী কোনো গণপরিবহনের ব্যবস্থা নেই স্থায়ীভাবে। ব্রীজের শহরে প্রান্ত থেকে রাস্তামাথা পর্যন্ত মাঝে দুই থেকে তিন কিলোমিটার পথ কীভাবে যাত্রীরা পাড়ি দিবে- সে ব্যবস্থা কেউ করছে না।’

স্থানীয়দের দাবি, কাপ্তাই রাস্তামাথা এলাকাতেই দীর্ঘদিন ধরে সিএনজি অটোরিকশাগুলো থেমে আসছে। সড়ক প্রশস্ত হওয়ায় এখানে এক পাশে গাড়ি থেকে যাত্রী নামানো এবং উঠানো যায়। বাহির সিগনাল এলাকায় গ্যাস নেয় গাড়িগুলো। আবার বোয়ালখালী থেকে আসা টেম্পুগুলো বহদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ডের আগে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সামনে এসে থামতে পারে। সেখান থেকে যাত্রী নামিয়ে তারা বোয়ালখালী ফিরে যেতে পারবে। এসব গাড়ি তাহলে শহরে আর প্রবেশ করবে না। অতীতেও সেভাবে গাড়িগুলো চলাচল করেছে। বর্তমান দুর্ভোগ নিরসনের এভাবে গাড়ির ব্যবস্থাপনা করা উচিত।

জানা গেছে, মেট্রো অঞ্চলের সিএনজি অটোরিকশাগুলোর সংগঠনের বাধার মুখেও পড়েছে গ্রামের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া সিএনজি অটোরিকশাগুলো। মেট্রো সার্ভিসের সিএনজি অটোরিকশা চালক ও মালিকদের দাবি, বিআরটিএ থেকে গ্রামে চলাচলের অনুমতি নিয়ে নগরীতে এসব গাড়ি প্রবেশ অবৈধ। এক্ষেত্রে এসব গাড়ি যেন নগরীর সীমানায় ঘেঁষতে না পারে সে জন্য তারা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপরও চাপ প্রয়োগ করছেন।

অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আজাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যাত্রীদের দাবির প্রেক্ষিতেই কাপ্তাই রাস্তামাথা এলাকায় সিএনজি অটোরিকশাগুলোকে আসতে হয়। কারণ এর আগে কোনো স্থান থেকেই শহরমুখী গণপরিবহন ছাড়ে না। আবার গ্যাস পাম্পও আছে রাস্তামাথা ও বাহির সিগনাল এলাকায়। বোয়ালখালীতে কোনো সিএনজি গ্যাস পাম্প নেই। কালুরঘাট ব্রীজ হেটে পার হয়ে হাজার হাজার যাত্রীকে এখন দুই কিলোমিটার পায়ে হেটে রাস্তামাথা এলাকায় আসতে হয়। এরপর তারা শহরমুখী যানবাহনে উঠতে পারছে। আমাদের দাবি, অতীতের মতো রাস্তামাথার পাশে বাহির সিগনাল এলাকা পর্যন্ত গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা আসতে দিতে হবে। না হয় হাজার হাজার যাত্রীর দুর্ভোগ বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুল শহরে গ্রামের কোনো সিএনজি অটোরিকশা যায় না, ভবিষ্যতেও যাবে না। তারা রাস্তামাথার পাশে বাহির সিগনাল এলাকায় গ্যাস নিতে যায়। সেখান থেকে রাস্তামাথায় এসে যাত্রী নেয়। এরপর চলে যায় কাপ্তাই লিচু বাগান ও বোয়ালখালীর পথে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপি’ ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (উত্তর) আলী হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাজ আইন প্রয়োগ করা। যাতে সড়ক যানজট মুক্ত থাকে। তবে যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয়ও আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবো। সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত নিবো।’

মুআ/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!