গ্যাস রাইজারের ১ লাখ পরীক্ষায়ও জায়গা হয়নি পাথরঘাটার

১৯৮৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) রাইজার রয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার। প্রথমবারের মত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের অধীনে নগরীর এক লাখ ৫ হাজার রাইজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও সেই তালিকায় ছিল না পাথরঘাটা এলাকার রাইজারগুলো। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ২৮টি টিমে উত্তর ও দক্ষিণ জোনে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় কার্বন ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট (সিডিএম) প্রকল্পের আওতায়।

এই পরীক্ষায় মোট দেড় লাখের মধ্যে এক লাখ ৫ হাজার রাইজার পরীক্ষায় শতকরা ৮ ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেই হিসাবে মোট ৮ হাজার ৪০০ রাইজার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সেই সময়েই মেরামত করা হয়েছিল ওই প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু ২৮ টিমের অধীনে চট্টগ্রামের প্রায় সব স্থানে এসব রাইজার পরীক্ষা করা হলেও যেই পাথরঘাটায় ‘গ্যাস লাইনের লিকেজ’ থেকে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে সাতজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সেখানে কোনও পরীক্ষক আসেননি। বিষয়টি স্বীকার করেছেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মত এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কার্বন ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট (সিডিএম) প্রকল্পের আওতায় নগরীর এক লাখ ৫ হাজার রাইজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ২৮ টিমে উত্তর ও দক্ষিণ জোনে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। তবে উত্তর জোনের অধীন কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটায় কোনও রাইজার পরীক্ষা করা হয়নি ওই সময়ে। এটা সম্পূর্ণ তাদের বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে বাইরের মানুষ দিয়েই করা হয়েছিল।’

তবে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও সেবা) মো. সারোয়ার হোসেন আবারও জোর দিয়ে বলেছেন, ‘পাথরঘাটায় গ্যাসের কোনও সমস্যা হয়নি। গ্যাসলাইনে ত্রুটি থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে বাসায় এই বিস্ফোরণ হয়েছে ওই বাসার গ্যাসের চুলাও অক্ষত আছে। আগুন লাগার ঘটনাও বড় আকারে ঘটেনি। গ্যাসের লাইন লিক কিংবা রাইজারের ত্রুটির কারণে ভবনের দেয়াল উড়িয়ে নেওয়ার কথা নয়। ভবনের ভেতর বা পাশে কোনও সেপটিক ট্যাংকে দীর্ঘদিনের জমা গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা রাইজারটি অক্ষত অবস্থায় পুলিশকে জমা দিয়েছি।’

যদিও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিএমপির গঠিত দুই তদন্ত দলের তদন্তেই উঠে এসেছে, পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডের বড়ুয়া ভবনে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা ঘরের ভেতর জমে থাকা গ্যাস থেকেই হয়েছে। রাতভর ওই কক্ষের দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় রুমটি গ্যাস চেম্বারে রূপ নেয়। গ্যাস পাইপ থেকে গ্যাস অনবরত নির্গমণ হচ্ছিল। কোন বদ্ধ ঘরে গ্যাস বা দাহ্য পদার্থ থাকা অবস্থায় তাপের উপস্থিতি থাকলেও অক্সিজেনের অনুপস্থিতির কারণে আগুনের উৎপত্তি না হলেও আগুনের সংস্পর্শ পেতেই বিকট শব্দে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ ঘটে।

কর্ণফুলী গ্যাসের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে বর্তমানে তাদের ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫টি আবাসিক বার্নার রয়েছে। এজন্য ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ, সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাইজার রয়েছে দেড় লাখ। তবে ১৯৮৪ সাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করে আসা সাবেক তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাসলাইন এবং রাইজারগুলো পুরনো। ফলে এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রায় সময়ে ছোট বড় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। মাঝেমধ্যে মূল লাইন পরীক্ষা করা হলেও বাসাবাড়ির সংযোগ লাইন পরীক্ষা করা হয় না।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ করে। এখান থেকে উত্তর ও দক্ষিণ ২টি ডিভিশন ও ১২টি জোনে গ্যাস বিতরণ করা হয়। দুর্ঘটনাস্থল পাথরঘাটা উত্তর জোনের অধীনে গ্যাস বিতরণ করা হয়। বিতরণ লাইনের মধ্যে হাইপ্রেসার লাইনে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও লো প্রেসার লাইনে গৃহস্থালি লাইন দেওয়া হয়।

এমএস লাইন এসে রাইজারে সংযোগ হয়ে তা জিআই লাইন হয়ে গৃহস্থালিতে সংযোগ হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানে ২ ইঞ্চি ও গৃহস্থালিতে ৩-৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপে সংযোগ দেওয়া হয়। এম এস লাইনে ৪ (বার) ও গৃহস্থালি লাইনে ২.৫ (মিলিবার) গ্যাসের চাপ থাকে। ১বার (১৪.৫ আইপিএস)। ৩ ফুট মাটির নিচে গ্যাসের পাইপলাইন বসানো হয়। পাইপগুলোর বাইরে টেপ দিয়ে মোড়ানো রয়েছে। ফলে টেপ ঠিক থাকলে সরবরাহ লাইন থেকে গ্যাস বের হওয়া সম্ভব নয়। টেপ খুলে যেতে পারে কিন্তু এটা পচে যায় না।

এ প্রসঙ্গে কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও সেবা) মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্যাসলাইন ও রাইজার নিয়মিত পরীক্ষার মতো পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই। তবুও নিয়মিতই গ্যাসলাইন পরীক্ষা করা হয়। পাথরঘাটার দুর্ঘটনার পর রাইজার পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ রাইজার ঘরের বাইরে দরজার পাশে বসানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও গ্রাহকরা এটাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তার। যেমনটি পাথরঘাটার বড়ুয়া ভবনের মালিকরা করেছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির আওতায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। আবাসিকের বিতরণ লাইনে ত্রুটি আছে কি না তা চিহ্নিত করতে হলে রাস্তা ও বাসা-বাড়ি খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। শুরুতে নগরীতে যেসব বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছিল তা অনেকাংশে ক্ষয় হয়ে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আবাসিকের বিতরণ লাইনের কোনো কাজ হয়নি। আবাসিকে সংযোগ প্রদান চালু থাকা অবস্থায় পুরোনো লাইনের মধ্যে প্রচুর নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে গ্যাসের চাপ বেড়েছে।

বর্তমানে সরবরাহ লাইনের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর জন্য ৩৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় কাফকো ও সিইউএফএলের সরবরাহ লাইনের কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় গ্রিড লাইন থেকে মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক জোন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ লাইন স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!