গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকেই পাথরঘাটার বিস্ফোরণ

দুই তদন্তে একই তথ্য

চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) নিজেদের করা তদন্তে নিজেদের দায়মুক্তি দিলেও অন্য দুটি তদন্ত কমিটির তদন্তে দায়ী করা হচ্ছে তাদেরই। ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে ঘটেছে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ। তেমনি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিএমপির গঠিত দুই তদন্ত দলের তদন্তেই উঠে এসেছে একই তথ্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ঘটনার দিনই বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ‘এখানকার রাইজারটা ছিল অধিক পুরনো এবং যে পাইপলাইনটা ছিল ওটা অতি পুরনো। পাইপলাইনটি রাবার দিয়ে মোড়ানোর কথা ছিল, কিন্তু পাইপলাইনে রাবার মোড়ানো ছিল না। তাই আমরা ধারণা করছি এই পাইপলাইনের যে কোনো একটা ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয়েছে। আমরা যেটা শুনছি, ওই বাসার মহিলা সকালে পূজা দেয়ার জন্য ম্যাচ জ্বালিয়েছিলেন। দিয়াশলাই জ্বালানোর সাথে সাথে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণটা এমনভাবে ঘটেছে যা সমস্ত রুমে এক সাথে ঘটছে। আর বিস্ফোরণের মাত্রা এত বেশি শক্তিশালী ছিল যে দুর্বল জায়গাগুলো ভেঙ্গে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে।’

একই কথা এসেছে সিএমপি ও জেলা প্রশাসনের তদন্তেও। দুই কমিটিই ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পাশাপাশি ভিকটিম, ভবনের বাসিন্দা, প্রত্যক্ষদর্শী, ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ বিস্ফোরণের জন্য বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নিয়েছেন। এমনকি সিএমপির তদন্ত কমিটিতে কাউন্টার টেরোরিজমের একজন বোমা বিশেষজ্ঞকেও তদন্তে যুক্ত করা হয়েছে।

তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির তদন্ত কমিটির প্রধান উপ কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান বলেন, ‘তদন্তকাজ চলছে। আরও কয়েকদিন লাগবে প্রতিবেদন জমা দিতে। আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলেছি। বারবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন তৈরি করতে পারব বলে মনে করছি।’

তবে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগে বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকেই পাথরঘাটার বিস্ফোরণ 1

তদন্ত শেষ পর্যায়ে জানিয়ে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এজেএম শরীফ হোসেন বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরের লোক নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা করছি।’

সিএমপির উপ-কমিশনার মেহেদী হাসানের মতো এডিএম শরীফ হোসেনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডের বড়ুয়া ভবনে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা ঘরের ভেতর জমে থাকা গ্যাস থেকেই হয়েছে। রাতভর ওই কক্ষের দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় রুমটি গ্যাস চেম্বারে রূপ নেয়। গ্যাস পাইপ থেকে গ্যাস অনবরত নির্গমণ হচ্ছিল। কোন বদ্ধ ঘরে গ্যাস বা দাহ্য পদার্থ থাকা অবস্থায় তাপের উপস্থিতি থাকলেও অক্সিজেনের অনুপস্থিতির কারণে আগুনের উৎপত্তি না হলেও আগুনের সংস্পর্শ পেতেই বিকট শব্দে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ ঘটে।

দেয়াল ধসে রাস্তায় পড়ার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, যখনই অক্সিজেন সেখানে আসবে তখন আগুনের উৎপত্তি হবে এবং প্রচণ্ড গতিতে অক্সিজেন যেদিক থেকে আসবে সেদিকে ধাবিত হবে। এতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে ঘরের দেয়ালটি রাস্তার পাশেই ধাবিত হয়েছে। এ ধরনের বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ফায়ার সার্ভিসের ভাষায় ‘ফ্ল্যাশ ওভার’ বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে তদন্ত কমিটি ২০১৭ সালে বাকলিয়া থানার দেওয়ান বাজার এলাকার নিরাপদ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ছয়তলা মাদ্রাসা ভবনের তিনতলার ১ নম্বর ফ্লাটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই বিস্ফোরণের সাদৃশ্য পেয়েছিল।

তবে গ্যাস লাইনের রাইজার উদ্ধার করার পর যে সংস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে সেই কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপক (রক্ষাণাবেক্ষণ) সরোয়ার হোসেন বলছেন, ‘এই বিস্ফোরণের যে ভায়বহতা এবং রাইজার দেখে জোর দিয়ে বলা যাবে না গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেইফটি ট্যাংকে জমা গ্যাস বিস্ফোরণ থেকেই ভয়াবহ এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। সিডিএর কর্মকর্তারাও বলছেন, ভবনের নিচে থাকা সেফটি ট্যাংক বিস্ফোরণ থেকেই ভয়াবহ এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রসঙ্গত, রোববার (১৭ নভেম্বর) সকালে নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডে বড়ুয়া ভবনের এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে নারী শিশুসহ সাতজন নিহত হন। এ ঘটনায় দগ্ধসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।

এডি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!