গোকুলাম রূপকথার অবসান, ফাইনালে চট্টগ্রাম আবাহনী

দু'বার পিছিয়ে পড়েও আবাহনীর জয়

ঠিক রূপকথার গল্পের মতোই। ঢাকা আবাহনী শেষ মুহুর্তে না করে দেয়ায় এএফসির শর্ত পূরণ করে ভারত থেকে উড়িয়ে আনা হয় গোকুলাম কেরালাকে। টুর্নামেন্টের জন্য কোনরকম প্রস্তুতি ও চট্টগ্রামে অনুশীলন ছাড়াই ম্যাচ খেলতে নেমে পড়ে তারা। প্রথম ম্যাচেই তারকা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসকে উড়িয়ে রূপকথার গল্প বুনন শুরু করে গোকুলাম। এরপর একে একে মালয়েশিয়ার তেরেঙ্গানু কিংবা স্বদেশী চেন্নাই এফসির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে রচিত হতে থাকে তাদের উপখ্যান। উঠে আসে টুর্নামেন্টের সেরা চারে। শেষমেশ স্বাগতিক চট্টগ্রাম আবাহনীর হাতে এসে কাটা পরে সুরের মূর্ছনা।

গোকুলাম কেরালার ফুটবল ছন্দের সুর কাটা পড়ার আগে দু’দুবার নিজেদের সুরের যাদুয় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল চট্টগ্রাম আবাহনীকে। কিন্তু নিজেদের ঘরের মাঠে শেষ মুহুর্তের এক ঝটকায় থেমে যায় গোকুলাম কেরালার রূপকথার গল্প। তাতে করে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপের তৃতীয় আসরে প্রথম দল হিসেবে ফাইনালে পৌঁছে গেছে চট্টগ্রাম আবাহনী। সোমবার প্রথম সেমিফাইনালে ভারতের শ্রী গোকুলাম কেরালা এফসিকে ৩-২ গোলে হারায় জামাল ভূঁইয়ার দল।

ম্যাচের বয়স তখন নব্বইয়ের ঘর ছুঁই ছুঁই, চট্টগ্রাম আবাহনী তখনও এক গোলে পিছিয়ে। এমন সময়ে ভেল্কি দেখালেন দিদিয়ের চার্লস। লড়াই অতিরিক্ত সময়ে তো নিলেনই, করলেন নিজের জোড়া গোলও। অতিরিক্ত সময়ে জমে ছিল আরও রোমাঞ্চ, এবার গোল করলেন পরীক্ষিত সৈনিক চিনেদু ম্যাথিউ। দুই দুইবার পিছিয়ে পড়েও তাতে ফাইনালে উঠে যায় টুর্নামেন্টের স্বাগতিকরা।

মঙ্গলবার দ্বিতীয় সেমিফাইনালে তেরেঙ্গানু এফসি ও মোহনবাগানের ম্যাচের পরই জানা যাবে কে হতে যাচ্ছে বৃহস্পতিবারের ফাইনালে স্বাগতিকদের শিরোপার প্রতিপক্ষ।

এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ম্যাচের প্রথম আক্রমণে যায় চট্টগ্রাম আবাহনী। পঞ্চম মিনিটে বল নিয়ে দারুণ গতিতে কেরালা ডি-বক্সে ঢুকে গিয়েছিলেন চিনেদু ম্যাথিউ। গোলবারের কাছে নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ডের কাটব্যাকে বল সতীর্থের পায়ে পড়ার আগেই ছোঁ-মেরে কেড়ে নেনে কেরালা গোলরক্ষক।

ম্যাচের ২১ মিনিটে আবারও গোছানো আক্রমণ আবাহনীর। আরিফুল ইসলামের পাসে বল পেয়ে প্রতিপক্ষ ডি-বক্সে ঢুকে গিয়েছিলেন ইয়াসিন আরাফাত। পরে কাটব্যাকে বল পাঠান রতকোভিচ লুকার পায়ে। জবাবে লুকার শটে জোড় থাকলে ফলটা আবাহনীর পক্ষেই আসতে পারতো!

বল দখলের লড়াইয়ে চট্টগ্রাম আবাহনীর থেকে পিছিয়ে থাকার পরও দু'বার এগিয়ে গিয়ে হার মানতে হয় গোকুলাম কেরালাকে। ছবি: আজীম অনন।
বল দখলের লড়াইয়ে চট্টগ্রাম আবাহনীর থেকে পিছিয়ে থাকার পরও দু’বার এগিয়ে গিয়ে হার মানতে হয় গোকুলাম কেরালাকে। ছবি: আজীম অনন।

বল দখলে পিছিয়ে থাকলেও ২৯ মিনিটে কাজের কাজটা ঠিকই সেরে নিয়েছে গোকুলাম কেরালা। ইকবল জনের ভুলে ডি-বক্সে বলের দখল নেন হেনরি কিসেক্কা। আরেক ডিফেন্ডার রিয়াদুল ইসলাম রাফি ব্লক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অভিজ্ঞ উগান্ডান ফরোয়ার্ডের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। বল পায়ে ঠাণ্ডা মাথায় যে শট নিলেন কিসেক্কা, তাতে কিছুই করার ছিল না আবাহনী গোলরক্ষক মোহাম্মদ নেহালের।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই সমতায় ফেরে স্বাগতিকরা। ৪৭ মিনিটে মানিক হোসেন মোল্লার পাসে গোকুলাম কেরালার দুই খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে কোনাকুনি শটে বল জালে জড়িয়ে স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভর্তি দর্শককে আনন্দে ভাসান দিদিয়ের চার্লস।

ম্যাচের ৬৩ মিনিটে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ ছিল স্বাগতিকদের সামনে। চিনেদু ম্যাথিউর পাসে ফাঁকায় বল গিয়েছিল রতকোভিচ লুকার কাছে। তবে প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে পারেননি এ মন্টেনেগ্রিয়ান ফরোয়ার্ড। ৭৫ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে একা দৌড়ে এসেও বল গোলরক্ষকের গায়ে মেরেছেন উইঙ্গার আরিফুল ইসলাম।

নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট বাকি থাকতে হৃদয় ভাঙে স্বাগতিক সমর্থকদের। হেনরি কিসেক্কার পাস থেকে বাম প্রান্তের দুরূহ কোণ হতে আড়াআড়ি শটে আবাহনী গোলরক্ষক নেহালের সঙ্গে দর্শকদের স্তব্ধ করে দেন গোকুলাম অধিনায়ক মার্কাস জোসেপ।

শেষ সময়ে গোলহজম করে শোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে আবাহনী। এই অবস্থায় অলআউট অ্যাটাককেই চোখ করেছিলেন স্বাগতিক খেলোয়াড়রা। ৮২ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট নিয়েছিলেন অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, অল্পের জন্য তা লক্ষ্য খুঁজে পায়নি। ৮৭ মিনিটে আবাহনীর তিন ফুটবলার মিলেও বলকে জালে ঠেলতে পারেননি।

এই অবস্থায় যখন আস্তে আস্তে হারই চোখ রাঙাচ্ছে স্বাগতিকদের, তখনই মরা গাঙে জোয়ার আনেন দিদিয়ের চার্লস। শেষ চেষ্টা হিসেবে বামপ্রান্ত দিয়ে আক্রমণ শানান বদলি মিডফিল্ডার কাউসার আলী রাব্বী। ডি-বক্সের মাথায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন দিদিয়ের। রাব্বীর কাটব্যাকে বল ঠিক জায়গায় পেয়ে যান আইভরি কোস্টের মিডফিল্ডার। চতুর দিদিয়ের বল পেয়ে তাড়াহুড়ো করেননি। ঠাণ্ডা মাথায় গোকুলােম গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে গোল করে দলকে নিয়ে যান অতিরিক্ত সময়ের খেলায়।

দুইবার গোল খেয়ে শোধ দেয়া আবাহনীর এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা। ১০৫ মিনিটে বাঁ-প্রান্ত দিয়ে কাউসার আলী রাব্বীর ক্রসে প্রথমে ভলি করেছিলেন চিনেদু ম্যাথিউ। সেই ভলি প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের মাথায় লেগে ফিরলে হেড নেন ম্যাথিউ। এবার আর লক্ষ্যচ্যুত হয়নি তার মাথা ছোঁয়া বল। লক্ষ্যভেদে দলকে ফাইনালে তোলেন নাইজেরিয়ান মিডফিল্ডার।

অতিরিক্ত সময়ের যখন বাকি দুই মিনিট, তখনই ১০ জনের দলে পরিণত হয় গোকুলাম। আবাহনী ডিফেন্ডার ইকবল জনকে মাথা ঠুকে লাল কার্ড দেখেন গোকুলাম ফরোয়ার্ড হেনরি কিসেক্কা। বাকি সময় দশজনকে নিয়ে প্রতিপক্ষকে আর গোল শোধ দিতে পারেনি গোকুলাম। তাতে দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিযোগিতাটির ফাইনালে উঠে যায় স্বাগতিকরা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!