গুঞ্জনে মনজুর, বিস্মিত বিরক্ত চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৃণমূল

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে নতুন কেউ মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জোরালো আলাপ চলছে নগরে। শেষবেলায় এসে আলোচনায় ঢুকে গেলেন বিএনপির সাবেক মেয়র ও খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মনজুর আলমের নামও। তবে এই গুঞ্জনকে ভালভাবে নিচ্ছে না স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এমন আলাপে বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

একসময় আওয়ামী লীগ থেকে কাউন্সিলর হওয়া মনজুর পরে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে চসিকের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে নির্বাচনের দিন কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছেন। একসময় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মনজুর দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকলেও মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে অনেকদিন ধরেই তৎপর ছিলেন। শেষবেলায় সরাসরি না বললেও সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ডাক দিলে ফের ভোটের লড়াইয়ে নামতে ইচ্ছুক তিনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বেশ কজন সিনিয়র নেতাও মনজুরের সমর্থনে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তবে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন না তারা।

এদিকে সিটি কর্পোরেশন মেয়র পদে মনজুরকে ঘিরে এই গুঞ্জনে যারপরনাই বিরক্ত স্থানীয় নেতা কর্মীরা। তারা বলছেন আদর্শহীন ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করা কাউকে নিয়ে ভাবার মত দুরবস্থা আওয়ামী লীগের নেই৷ এছাড়া মেয়র পদে কোন উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই মনজুরের। এসব কারণে মনজুরকে নিয়া চলা আলোচনার বিষয়ে বিস্ময়ও প্রকাশ করেন অনেকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে দলবদল নিয়ে কম নাটকীয়তা করেননি মনজুর। মেয়র হতে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে গেলেন। গত বার মেয়র হতে না পেরে সেই দলও ছেড়ে দিলেন। এরপর কিছুদিন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করলেন। এখন মেয়র পদে মনোনয়নের জন্য তদবির করছেন। পুরো ব্যাপারটাতেই রয়েছে ক্ষমতা প্রাপ্তির স্বপ্ন। আদর্শিক কোন তাগিদ তো নেই। তা থাকলে তো তিনি ভুল স্বীকার করে আওয়ামী লীগে ফিরতে পারতেন। তা তো করেননি। এমন একজনকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিতে হবে এরকম পরিস্থিতি তো নেই। শুনেছি সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ এই বিষয়ে চেষ্টা তদবির করছেন। যদি এমন কিছু হয় তাহলে সেটা খুব হতাশাজনক একটা ব্যাপার হবে।’

তবে গত ৫ বছর আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত না রাখলেও, নগরীর কাট্টলী এলাকাকেন্দ্রিক সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন মনজুর আলম। মেয়র হওয়ার আগে ওই এলাকারই কাউন্সিলর ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন। তাছাড়া প্রতি বছর আগস্ট মাসে নানা কর্মসূচি নিয়ে সরব হয়ে থাকেন মোহাম্মদ মনজুর আলম। মোস্তাফা হাকিম গ্রুপের এ কর্ণধার চট্টগ্রামের নামকরা শিল্পপতি—সদালাপী ও বিনয়ী হিসেবেও পরিচিত। মনজুর শোকের মাস আসলেই কখনও ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’ আবার কখনও পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যানার থেকে মেতে উঠেন বঙ্গবন্ধু বন্দনায়।

গত আগস্টে মনজুরের এসব মৌসুমী কর্মকান্ডকে ঘিরে তুমুল সমালোচনা করেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

সেসময় মনজুর আলমের ‌‘বঙ্গবন্ধু বন্দনা’ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডা. আফসারুল আমীন এমপি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়েই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আলোচনা-সমালোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে। এখন আপনি যার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন তিনি সেই ক্যাটাগরিতে পড়েন কিনা আপনিই বলুন? এখন কেউ যদি ক্ষমতার লোভে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বর্জন করার পর আবার বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হয়ে উঠেন তা রহস্যজনক ও হাস্যকর। এরপরও উনাকে (মনজুর আলম) নিয়ে আমার মন্তব্য করার ইচ্ছা নেই।’

মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বন্দনা করা হচ্ছে জানিয়ে আফসারুল আমিন বলেছিলেন, ‘কথা বলতে চাইছিলাম না। এরপরও বলতে হয়। তিনি তো আদর্শবিবর্জিত একজন রাজনীতিক। ওয়ান ইলেভেনের সময় তার কী ভূমিকা ছিল তা সকলেই জানেন। এছাড়া তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ক্ষমতার লোভে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপি থেকে মেয়র হয়েছিলেন। আবার সেই ব্যক্তিই যদি আওয়ামী লীগের থেকে মেয়র হতে চান তা হাস্যকর।’

তবে এমন সম্ভাবনাকে সেসময়ই নাকচ করে দিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আফসারুল আমিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীর এতোই অভাব হয়নি যে, আদর্শবির্বজিত কাউকে এনে মেয়র নির্বাচন করাবে। এখন যদি কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম বিক্রি করে তার নামে অনুষ্ঠান করেন তাহলে তিনি আওয়ামী লীগার হয়ে যাবেন কিংবা মেয়র নির্বাচন করতে পারবেন সেটা ভাবা বোকামি। আসল কথা হচ্ছে তিনি (মনজুর আলম) যে কোনও নির্বাচন আসলেই সরব হয়ে উঠেন। নির্বাচন করার জন্য নানা কাণ্ড করেন। গত সংসদ নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে এখন হয়তো মেয়র নির্বাচনের জন্য এমন করছেন। মূল কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক আদর্শ থেকে না, যেদিকে ক্ষমতা সেদিকেই ভিড়েন মনজুর আলম।’

১৯৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে টানা তিনবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৬ বছর কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করেন মনজুর আলম। পরে ২০১০ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করেন তিনি। প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে মনজুরের কাছে হেরে যান তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মনজুর আলম আবার বিএনপির সমর্থনে মেয়র প্রার্থী হলেও নির্বাচনের দিন সকালে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেন। এমনকি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাও দেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক এ উপদেষ্টা।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!