গিটারিস্ট বাবন হত্যার ১৭ বছর/ ‘আমারও মন ভাঙে, চোখে আসে অশ্রু’

১৭ বছর ধরে আমি বলে চলেছি একই কথা। ভুলতেও পারি না। কী আর করা! বুকের ভেতর এক অব্যক্ত ব্যথা নিজে থেকেই বলে উঠে, ‘তুমি তো পরাজিত। পারলে না তোমার ভাইকে কেন মেরে ফেলা হলো তা জানতে? কিসের সাংবাদিকতা করো তুমি?’

প্রায়ই ভাবি বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু কিইবা আমি করতে পারতাম? চেষ্টা যে করিনি তা তো নয়। কিন্তু রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী কিছু সাংবাদিক আর ব্যবসায়ীর কাছে হেরে গেছি। তাদের টাকার প্রভাব আর প্রতিপত্তির সাথে আমি কোনভাবেই পেরে উঠিনি। ছিল আরো কতো হুমকি।

আমার ছোট ভাই সুতনু নন্দী বাবনের কথা বলছিলাম। যার গিটারের যাদু আমাকে তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর আমার বিয়ের মাত্র এক বছর পর আমাকে ঢাকা থেকে তাঁর নিথর দেহ বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে চট্টগ্রামে।

guitarist-baban
বাবন ফোন ধরেই বলেছিল- ‘অশোক দা আমাকে বাঁচান।’

চট্টগ্রামের এক ব্যান্ড গ্রুপে গিটার বাজিয়ে গান গাইতো বাবন। তাকে ২০০২ সালের ১১ জুন গিটার বাজানোর কথা বলে তার কয়েকজন বন্ধু ঢাকায় নিয়ে যায়। ঢাকায় যাওয়ার পর আমরা তার কোন খবর পাচ্ছিলাম না। ১৩ জুন রাতে খবর পাই, বাবন খুবই অসুস্থ। সেদিন মধ্য রাতে ফয়সাল নামে বাবনের এক বন্ধুর মাধ্যমে ফোনে আমার সঙ্গে শেষ কথা হয় বাবনের। অনেক অনুরোধের পর ফয়সাল আমাকে বাবনের সাথে কথা বলতে দিয়েছিল। বাবন ফোন ধরেই আমাকে বলেছিল- ‘অশোক দা আমাকে বাঁচান।’ আমি কিছু জানতে বা বলতে চাওয়ার আগেই ফোনের লাইনটা কেটে দেওয়া হয়।

তারপর থেকে ফোনটি কেবলই বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য মাধ্যমে ফোন করে শুধু জানতে পেরেছিলাম বাবনকে রাজধানীর মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর সাহায্য চেয়ে ফোন করেছিলাম আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে। বন্ধু সেই হাসপাতালে গিয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ডাক্তার হিসেবে তার যে উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, তার কিছুই সে করেনি। এরপর আর কোনভাবেই ডাক্তার বন্ধুটিকে রাতের ঘুম থেকে জাগাতে পারিনি। অথচ এই বন্ধুর জন্য আমি একসময় অনেক কিছু করেছিলাম। আশা করি সেটা সে ভোলেনি।

ডাক্তার বন্ধুকে না পেয়ে গভীর রাতে অনেক কষ্ট করে হাসপাতালের ফোন নাম্বার যোগাড় করি। সেখানে ফোন দিলে তারা জানান, রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পরদিন ১৪ জুন ভোরে ঢাকা যাওয়ার আগে জানতে পারি, আগের রাত ২টার দিকে কে বা কারা বাবনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফেলে রেখে যায়।

ভোর হলে আমি সহযোগিতা চাই সাংবাদিক বড় ভাই নঈম নিজামের কাছে। তিনি চন্দন সিনহাকে সাথে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে খোঁজ করে জানতে পারলেন গভীর রাতে নাম পরিচয়বিহীন এক রোগী এসেছিল। ওই রোগী ভোরে মারা গেলে তাকে মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রকৃতিও মনে হয় সেই মৃত্যুতে অঝোর ধারায় কাদঁতে শুরু করে। ভোরবেলার ভারী বৃষ্টির মধ্যে নঈম নিজাম ও চন্দন সিনহা গিয়ে দেখেন, মেডিকেলের মর্গের সামনে খোলা আকাশের নিচে বেওয়ারিশ হিসেবে বৃষ্টিতে ভিজছে বাবনের দেহ।

সেই থেকে ১৭ বছর পেরিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের সংগীত সাধক ওস্তাদ মিহির নন্দী তাঁর একমাত্র ছেলে সুতনু নন্দী বাবন হত্যার বিচার চাইতে চাইতে না পেয়ে নিজেই চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়ে। তিনি তো ননই, আজ পর্যন্ত আমরা কেউই জানতে পারলাম না, গিটার বাজাতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া বাবনকে কারা, কেন মেরে ফেললো?

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মিথানল বিষক্রিয়ায় বাবনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ শুরু থেকেই ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায় এবং মামলা নিতেও গড়িমসি করে। পরে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজনের হস্তক্ষেপে প্রথমে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করা হয়। পরে আমাদের উদ্যোগে সিআইডির কাছে মামলাটি পাঠানো হয়। এ হত্যাকাণ্ডে পাঁচ যুবক জড়িত থাকার কথা পুলিশ থেকে জানার পর সিআইডি শুরুতে দ্রুতগতিতে মামলা তদন্তের উদ্যোগ নেয়। কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এরপর অজানা কারণে তদন্ত আর এগোয়নি। এমনকি প্রধান আসামিকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। তদন্ত ঝিমিয়ে পড়ায় গ্রেফতারকৃত আসামিরাও বেরিয়ে যায়।

ভিসেরা রিপোর্টে বাবনকে হত্যার যথেষ্ট আলামত পাওয়া সত্ত্বেও তদন্ত সংস্থা সিআইডি মামলার কোন তদন্ত না করে, বাদী এবং সাক্ষীদের সঙ্গে কথা না বলে রহস্যজনকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। এর অর্থ পুলিশ কোন অপরাধ খুঁজে পায়নি। ফলে আমাদের পরিবার বঞ্চিত হয় ন্যায়বিচার থেকে। মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করে সঠিক তদন্তের জন্য আমরা বেশ কয়েক দফা চেষ্টা করেও কোন ফল পাইনি। বিচার না পাওয়ার এই কষ্ট নিয়ে অনেকের কাছেই ছুটে গিয়েছিলাম। সবাই শুধু আশ্বাস আর সান্ত্বনাই দিয়েছে। কিন্তু বিচার পাইনি ১৭ বছরেও।

তিন দশক ধরে সাংবাদিকতা করে মানুষের এতসব খবর বের করেছি, কিন্তু বাবনের হত্যার পেছনের খবরটি আজও বের করতে পারিনি। তার হত্যার বিচারও নিশ্চিত করতে পারিনি আজও। নিজেকে তাই সত্যিই একজন পরাজিত ব্যক্তি মনে হয়। আমার কেবলই ভাবনায় আসে যে, আমাদের পরিবারের কি কোন অধিকারই নেই জানার—কেন কারা বাবনকে হত্যা করলো? কেন সমস্ত কিছু থাকার পরও বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে বাবন পড়েছিল?

ডাক্তারদের কাছে জানতে পেরেছিলাম, মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার ওষুধ তখন পেলেই বাবন বেঁচে যেতো। পরিবারের কেউ তার সাথে ছিল না। বাবনকে কেউই সেই ওষুধ দেয়নি। আমার ছোট ভাইটিকে বাঁচাতে না পারার এই কষ্ট যেমন আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, তেমনি বিচার না পাওয়ার গ্লানিতেও কাটবে বাকী জীবন।

বাবন তুমি জেনো, আমরা তোমাকে কোনদিনও ভুলবো না।

অশোক চৌধুরী: বার্তা প্রধান, বৈশাখী টেলিভিশন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!