গাড়ি কম ভাড়া বেশি, দুর্ভোগের শেষ কোথায়!

গণপরিবহন সংকট

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নিলেই শ্রমিক-মালিক নেতারা ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করেন। জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে প্রশাসনও তখন নমনীয় হতে বাধ্য হয়। বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে চালক-হেলপার, মালিককে কারাদণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার (২১ অক্টোবর) অঘোষিত ধর্মঘটে সড়কে হঠাৎ গণপরিহন উধাও হওয়ায় পরিবহন সংকটে চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, গণপরিবহন সেক্টরে এই জিম্মিদশার শেষ কোথায়।

গণপরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। রয়েছে ট্রাফিক আইনভঙ্গ, রুট পারমিট অনুযায়ী চলাচল না করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে যাত্রীকে চাকায় পিষে মারা সহ নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস ফেরত যাত্রীদের হয়রানি ও বৃহস্পতিবার যাত্রীদের চাপকে পুঁজি করে উত্তর চট্টগ্রামে ৩ নম্বর রুট ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ এলাকায় দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এছাড়া দুই ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের চাপকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হয়ে থাকে। এজন্য বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও কারাদণ্ড করলেও, কিছুদিন পর আবারো একই চিত্র ফিরে আসে।

নগরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগ কোনো পদক্ষেপ নিলেই মালিক আর শ্রমিকদের চাপে শেষ পর্যন্ত তা থমকে যায়। দুই বছর আগে বিআরটিএতে পদায়ন হওয়া তিন ম্যাজিস্ট্রেট সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ট্রাফিক আইনভঙ্গ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি জব্দ ও জরিমানা করেছেন। গত তিনমাস ধরে ম্যাজিস্ট্রেট সংকটে রয়েছে বিআরটিএ। গত ৪ আগস্ট বিআরটিএ’রভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপরাধে দুইদিনে চার গাড়িকে ৫৬ হাজার টাকা জরিমানা করায় চট্টগ্রাম-ঢাকা-বেনাপোলের ৬৮টি রুটে ধর্মঘট ডাকে পরিবহন নেতারা।

পরিবহন শ্রমিক নেতাদের দাবি ম্যাজিস্ট্রেট তাদের হয়রানি করছেন। পরে জেলা প্রশাসক পরিবহন মালিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। ৭ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে জরিমানা করেছেন এমন অভিযোগ তুলে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ৭২ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। পরে মেয়রের সাথে আলোচনা করে দাবি পূরণের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ২০ অক্টোবর বহদ্দারহাটে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর দায়ে চালক, হেলপার ও মালিককে যথাক্রমে ১ মাস ও ১৫ দিন করে কারাদণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন হঠাৎ করে ধর্মঘট ডেকে বসে পরিবহন মালিকরা। এতে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিভিন্ন সময় হয়রানির অভিযোগ করে আসছে পরিবহন মালিকরা। যদিও সাধারণ মানুষ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বিআরটিএ’র অভিযানে সন্তুষ্ট।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে ১০ অক্টোবর থেকে প্রাথমিকভাবে ১০ ও ৬ নম্বর রুটে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু হয়। এতে দুই রুটে হঠাৎ করে গণপরিবহন উধাও হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক পুলিশিংয়ে যুক্ত করা হয়। অধিকাংশ মালিক-চালক যে কোনো ধরনের অভিযানকে স্বাগত জানালেও, কিছু মালিক-চালক তাতে চাপ সৃষ্টি করে। হঠাৎ করে ধর্মঘট ডেকে বসে তারা। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই জিম্মিদশা সংস্কৃতির শেষ কোথায়! অথচ হঠাৎ করে ধর্মঘট ডেকে মানুষকে জিম্মি করা অমানবিক। আইনত নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়নের ধর্মঘট ডাকতে হলে তা ৯০ দিন আগে সরকারকে অবহিত করতে হয়। যদি তাতে সাড়া পাওয়া না যায় তাহলে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেওয়া অথবা সংবাদ সম্মেলন হতে পারে। গণপরিবহন ব্যবসায় সরকার নিয়মিত প্রণোদনা দিয়ে আসছে। ফলে গণপরিবহনে কোনো ধরনের আয়কর দিতে হয় না। সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েও পরিবহন নেতারা জনগণকে জিম্মি করছে। এসব পরিবহন নেতাদের আইনের আওতায় এনে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ গণপরিবহন ব্যক্তি মালিকানাধীন। এছাড়া এই সেক্টরে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। ফলে একশ্রেণির পরিবহন নেতার কাছে চালক-মালিক ও যাত্রীরা আজ জিম্মি হয়ে পড়েছে। এজন্য নগরীতে দৈনিক ভাড়ার পরিবর্তে বেতনভিত্তিক চালক নিয়োগ, নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে গণপরিবহন পরিচালনা, রুট সংখ্যা কমানো, সড়কে পর্যাপ্ত বিআরটিসির বাস বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার সাথে পরিবহন মালিকদের কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়নি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, আমাদের দেশে পরিবহন নেতারা যেভাবে হঠাৎ ধর্মঘট ডেকে যাত্রীদের জিম্মি করে দাবি আদায় করেন, তা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে কল্পনা করা যায় না। সরকার চাইলে এই সেক্টরে কঠোর আইন প্রয়োগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পরিবহন সেক্টর কেন আইন মানবে না! নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে গণপরিবহন পরিচালনাসহ এই সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত ও শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নয়নের মূল সড়কে উঠতে গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিকল্প নেই।

নিরাপদ সড়ক চাই ( নিসচা) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম আজাদ খান বলেন, এভাবে মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় কখনো কাম্য নয়। এই জিম্মিদশার একটি সমাধান প্রয়োজন। যাত্রী, পথচারী, চালক, মালিক সবাইকে আইন মানতে হবে। গণপরিবহন সেক্টরের লোকেরা কেন আইন মানবে না! এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রশাসন সড়কে পর্যাপ্ত বিআরটিসি বাস দিতে পারে। তাছাড়া সড়কে চাপ কমাতে নৌ ও রেলপথের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি।

সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!