‘গান মারি দিইয়্যে’ গফুর হালী, বিস্ফোরক অভিযোগ সিরাজুল ইসলাম আজাদের

আইনি পথে হাঁটার হুমকি গফুর হালী রিসার্চ সেন্টারের

খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী আবদুল গফুর হালীর বিরুদ্ধে গান নকল করার অভিযোগ এনেছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী ও গীতিকার সিরাজুল ইসলাম আজাদ। তিনি একই অভিযোগ এনেছেন আরেক জনপ্রিয় শিল্পী সনজিৎ আচার্য্যের বিরুদ্ধেও।

দেশের খ্যাতিমান গীতিকার, সুরকার ও লোকশিল্পী আবদুল গফুর হালী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী, মুর্শিদি, মারফতি প্রভৃতি ধারায় দুই হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। ২০১০ সালে তাকে নিয়ে নির্মিত হয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র মেঠোপথের গান। হালী নিজের রচিত অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। এছাড়াও রচনা করেছেন একাধিক আঞ্চলিক নাটক। আস্কর আলী পণ্ডিতের ভাবশিষ্য হালী যদিও নাটক রচনা ও সুরও সৃষ্টি করেছেন। চট্টগ্রামের পটিয়ায় জন্ম নেওয়া এই লোকশিল্পী ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর মারা যান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের প্রথম শিল্পী হিসাবে কপিরাইট সনদ পায় আবদুল গফুর হালীর ৩০০ গান ও ছয়টি আঞ্চলিক নাটক।

অন্যদিকে সিরাজুল ইসলাম আজাদ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান গেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। ‘ও মামুরে হেডমাস্টারে তোয়ারে তোয়ার’ গানটি দিয়ে তিনি প্রথম নজর কাড়েন সকলের। গান রচনার পাশাপাশি তিনি নিজে সুরারোপও করে থাকেন। চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আজাদের গাওয়া গান স্থান পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা পরিচালনা দপ্তরের অধীনে প্রণীত চট্টগ্রামের লোকগান ও লোককবি নিয়ে একটি গবেষণা গ্রন্থেও।

‘হেডমাস্টার’ খ্যাত কন্ঠশিল্পী সিরাজুল ইসলাম আজাদ সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, আবদুল গফুর হালী তার যে গানটি নকল করেছেন, সেটি লেখা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। কথা ও সুর দুটিই তার। গানটি হচ্ছে— ‘ধন হারাইলে ধন পাওয়া/ যদি ভাগ্য ফিরে/ মা হারাইলে মা মিলে না/ দুনিয়ার ভিতরে/ ওমা মা মারে তোর তুলনা দুনিয়াতে নাই।’

অন্যদিকে ১৯৯৪ সালে কক্সবাজারের চকরিয়ায় প্রথম বিজয়মঞ্চে পরিবেশনের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের নিয়ে লেখা সিরাজুল ইসলাম আজাদের একটি গান নকল করার অভিযোগ উঠেছে সনজিৎ আচার্য্যের বিরুদ্ধেও। গানটি হল—
মারে আর ন ফেলাইছ চোগর পানি/ মুচি ফেলা আচল টানি/ দুঃখ কিয়র যুদ্ধে যদি জীবন অইলেও শেষ/ তার বদলে দিলাম তোরে একখান স্বাধীন দেশ, মা/ এই সোনার বাংলাদেশ।’

সিরাজুল ইসলাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০০২ সালে চট্টগ্রামের ক্যাসেট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আমিন স্টোরের ব্যানারে আমার ‘হেডমাস্টার’ ক্যাসেটটি যখন জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তখন দেশবরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ শ্রদ্ধেয় মরহুম শিল্পী আবদুল গফুর হালীর সাথে আমার সুসম্পর্ক ঘটে। সেই সুবাদে উনি বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন। আর প্রতি অনুষ্ঠানে আমি অন্যান্য গানের সাথে উল্লেখিত গানগুলোও পরিবেশন করতাম। প্রায় ১০ বছর আগে চট্টগ্রামের সাংবাদিক নাসিরউদ্দিন হায়দারের বাসায় গানের বিষয়ে গিয়েছিলাম। আমি যাবার কিছুক্ষণ পর শ্রদ্ধেয় মরহুম শিল্পী আবদুল গফুর হালীও সেখানে যান। আলাপচারিতার এক ফাঁকে নাসিরউদ্দিন হায়দার আমাকে বললো— ‘সিরাজ দা অনর আগর মা-র গাননুন এই সমত রেকর্ডিং গইল্লে ভালা অইতো। হেত্তে নইলে গাননুন বুজি যাইবো গই।’ তখন শ্রদ্ধেয় আবদুল গফুর হালী আমাকে বলে উঠলেন, ‘ভাগিনা আইঁ তো গান হেগুন মারি দিয়্যি’ অর্থাৎ নকল করে ফেলেছি।

‘গান মারি দিইয়্যে’ গফুর হালী, বিস্ফোরক অভিযোগ সিরাজুল ইসলাম আজাদের 1

শুনে আমি ভারাক্রান্ত মনে বললাম— ‘মামু আঁই তো অনর ঠেন্গর তলার ওগ্যা বালুর সমান ও নঅইয়ম, আরঁ সামান্য গাননুন মারি দঅন পরে না।’ আমার কথা শোনার কিছুক্ষণ পর গফুর হালী ওখান থেকে চলে যান। তখন আমি নাসির হায়দারকে বললাম— ‘নাছির ওনি এত বড় একজন গুণী মানুষ কি কাম গইজ্যে চঅ।’ তখন নাসির হায়দারও মনে হয় দুঃখ নিয়ে বলছিলো— ‘মানুষ্যেয়াত্তুন হেই জাইত্যা কিছু অভ্যাস আছে।’ এর কিছুদিন পর শুনলাম শ্রদ্ধেয় মরহুম শিল্পী নাছির সাহেবের ছেলে হারুনের ক্যাসেটে আবদুল গফুর হালীর লেখা ও উল্লেখিত সেই আমার লেখা ‘ধন হারাইলে ধন পাওয়া যায় মায়ের’ গানটার নকল গান। আর ওনার রচিত ‘সুরের বন্ধন’ বইটিতে দেখলাম— আমার লেখা ‘স্বাধীনতা শহীদান’দের নিয়ে লেখা গানটির নকল করা গান। যেমন— ‘মা আর ন ফেলাইছ চোগর পানি/ তার বদলে দিয়্যি তুরে মুখর ভাষা আনি।’

সিরাজুল ইসলাম আজাদ তার আরও কয়েকটি গান নকল করা নিয়ে বলেন, ‘প্রায় ছয় কি সাত বছর আগে চট্টগ্রামের সঙ্গীতশিল্পী সঞ্জিত আচার্য্য আমাকে পটিয়া শাকপুরায় একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সাথে শিল্পী ইউনুছ বাঙ্গালীসহ অন্যান্য শিল্পীরাও ছিলেন। আমি মঞ্চে উঠে প্রথমে ‘মায়ের গান’ দিয়ে শুরু করি। তারপর অন্যান্য গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসি। তখন সঞ্জিত ভাই আমাকে বললো— সিরাজ ভাই মায়ের গানটি কার লেখা? তখন আমি বললাম— ‘আমার লেখা। তখন সে বললো, ওই গানটা তো তপন আচার্য্যের লেখা বলে দাবি করেছে সে।’ তখন আমি বললাম— ‘তপন বলে থাকলে মিথ্যা বলেছে। আমার গান কেন তার বলবে— প্রশ্নই উঠে না। আমি তারে ধরবো।’ পরে এক অনুষ্ঠানে এ ব্যাপারে তপনকে জিজ্ঞেস করলে সে বললো— ‘আমি পাগল নাকি, আপনার গানকে আমার বলবো কেন?’ এর কিছু দিন পর থেকে শিল্পী সন্জিত আচার্য্যের কন্ঠে শোনা যেতে লাগলো, আমার লেখা সেই ‘মায়ের গান’টির নকল করা গান।’

সিরাজুল ইসলাম আজাদ দাবি করেছেন, গত ৩২ বছর ধরে তিনি গানগুলো গেয়ে আসছেন। এর লিখিত প্রমাণ হিসেবে ওই সময়ে লেখা ডায়রির পাতা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি তারা আমার আগে লিখতো, তাহলে এতোদিন তারা গায় নাই কেন? এসব বিষয়ে কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করতে চান, আমি তার সাথে বসতে রাজি আছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি এই পর্যন্ত প্রায় এক হাজারেরও বেশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পল্লীগীতি ও আঞ্চলিক গান রচনা করেছি। আমার লেখা এত গান থাকতে দুই একটা গানের জন্য মিথ্যা অভিযোগ করে দেশের গুণি শিল্পীদের হেয়প্রতিপন্ন বা মানহানি করার মত মন মানসিকতা আমার থাকতে পারে না।’

এদিকে আবদুল গফুর হালীর মৃত্যুর পর তার মতো একজন নামি শিল্পীর বিরুদ্ধে গান নকলের অভিযোগের পক্ষে ও বিপক্ষে সরব অনেকেই। আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টার এ নিয়ে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম আজাদের আনা অভিযোগকে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করে ‘আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টারের’ সেক্রেটারি, সাংবাদিক ও লোকগীতি গবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘অজস্র কালজয়ী গানের স্রষ্টা, চাটগাঁইয়া গানের কিংবদন্তী আবদুল গফুর হালীকে গান নকল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে হেডমাস্টরখ্যাত শিল্পী সিরাজুল ইসলাম আজাদ আমাকে উদ্ধৃত করে যেসব কথা বলছেন সেসব আগাগোড়া মিথ্যা।’

তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে সিরাজ আর গফুর হালী চাচা আমার বাসায় এসেছিলেন। সেখানে আমরা একসাথে খেয়েছি, আমার অনুরোধে সিরাজ তার মা গানটি করেছে। সিরাজের গান এখনও আছে আমার মোবাইলে। তাহলে ২০০৭ সালের বিষয় নিয়ে এতোদিন পর কেন অভিযোগ তুললেন সিরাজ? তাও আমাকে সাক্ষী রেখে। গফুর হালী চাচা মারা গিয়েছেন ২০১৬ সালে। একজন মৃত মানুষকে চোর বানানোর কারণ কী? তাও আমাকে সাক্ষী রেখে? যে মানুষটিকে নিয়ে আমি এত গবেষণা করলাম, যে মানুষটিকে আমি বাপের মতো শ্রদ্ধা করি, সিরাজ কেন আমার বরাত দিয়ে তাকে চোর বানাতে চাইল? আমাকে বিভিন্ন সময় সিরাজ এই ধরনের কথা বলতে চেয়েছে, আমি নাকচ করেছি, বলেছি গফুর হালী চাচা সেদিন তেমন কোন কথা বলেননি। তারপরও সিরাজ এতদিন পর এমন অভিযোগ তুলল? শত শত মানুষ গফুর হালী চাচাকে নিয়ে অসম্মানজনক কথা বলল?’

নাসির উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘যে দুটি গানের কথা সিরাজ লিখছে সেই গানগুলো ২০১৪ সালে আবদুল গফুর হালী চাচার জীবদ্দশায় প্রকাশিত ‘শিকড়’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই বইয়ের ১০০ গানের কপিরাইট সনদও পেয়েছে আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টার। স্বাধীনতার যে গান সেটি গফুর হালী চাচা লিখেছেন ১৯৭৬ সালে। আর সিরাজের গান ওটা আমরা শুনেছি ১৯৯৪ সালে চকরিয়া বিজয় মেলায়। তাহলে গফুর হালী চাচা কিভাবে সিরাজের গান নকল করবে? কই তখন তো সিরাজ কিছু বলেনি। গফুর হালী চাচা বেঁচে থাকতে সিরাজের সাথে বেতারে চাচার প্রায় দেখা হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কই চাচার সামনে দাঁড়িয়ে সে গান নকলের কথা বলার সাহস তো সিরাজের ছিল না। আজ উনি নেই, উনার মতো দেশবরেণ্য একজন সংগীতজ্ঞ চোর বানানোর কারণ কী?’

তিনি বলেন, ‘আর স্বাধীনতার যে গানের কথা বললো সিরাজ, সেটা তো গফুর হালী চাচা সত্তরের দশকে লিখেছেন। আমার কাছে উনার সব পাণ্ডুলিপি আছে, বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। ওই গান যখন হালী চাচা লিখেছেন তখন সিরাজ তো স্কুলে পড়ে।’

নাসির উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘সিরাজ যদি তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করে, তাহলে তাকে প্রমাণ করতে হবে গফুর হালী চাচা কিভাবে তার গান নকল করলো। নইলে আমি আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমি নিজে বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করব।’

এদিকে কেউ কেউ বলছেন, আবদুল গফুর হালী ও সিরাজুল ইসলাম আজাদ— দুজনের গান সম্পূর্ণ দুই রকম। গানের ভাব এক হতে পারে, কিন্তু কখনও গান দুটি এক নয়। তাদের যুক্তি— আবদুল গফুর হালীর ‘শিকড়’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, তিনি গানটি লিখেছেন ১৯৮২ সালে আর সিরাজুল ইসলাম আজাদ ১৯৮৯ সালে। তাহলে কি সিরাজুল ইসলাম আজাদ গানটি উল্টো কপি করেছেন— এমন প্রশ্নও উঠেছে।

এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম আজাদ বলেছেন, ‘গফুর হালীর গানের বইটি সম্পাদনা করেছে সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার। যার কারণে নাসির নিজেরটা রক্ষা করতে কৌশল অবলম্বন করে তারিখটা আমারটার আগে বসিয়ে দিয়েছে। কারণ নাসির গফুর হালীর গানের গবেষক ও ওনার গানের বইয়ের সম্পাদক।’

এর পাল্টায় নাসির উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘আমি গানের তারিখ পাল্টে দেবো কেন? ২০১৪ সালে বইটি যখন প্রকাশিত হয় তখন কি তিনি কোনো অভিযোগ করেছিলেন কিংবা এই গানটি কি কোনো আলোচনায় ছিল? তাহলে শুধু আমি গানের তারিখ পাল্টাবো কেন? তাছাড়া আমি তো আবদুল গফুর হালীর ‘শিকড়’ গীতিকাব্য সম্পাদনার সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলাম না।’

আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টার ও পিএইচপি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘গফুর স্যার যখন জীবিত ছিলেন, তখন কেন এসব বিষয়ে আলোচনা হয়নি? এখন যদি বলি নবাব সিরাজউদ্দৌলা আমার খালাতো ভাই ছিলেন, এর কি কোনো গুরুত্ব আছে? আমি মনে করি, এ ধরনের অভিযোগ আনা সাইবার অপরাধ। আমরা আইনি পদক্ষেপ নেবো প্রয়োজনে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!