‘গরিবের ডাক্তারের’ চিরবিদায় কাঁদাচ্ছে মানুষকে

চট্টগ্রামের পটিয়ার গরিবের ডাক্তারখ্যাত ডা. চিত্তরঞ্জন নাথের মৃত্যুতে কাঁদছে হাজারও মানুষ। চিকিৎসাসেবায় মানবতার উদাহরণ তৈরি করা এই চিকিৎসককে হারিয়ে পাঁচুরিয়ার ঘরে ঘরে চলছে শোকের মাতম।

মহামারি করোনার সময় যেখানে অন্য ডাক্তাররা রোগী দেখতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন পটিয়ার পাচুঁরিয়া এলাকার রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে এগিয়ে আসতেন চিত্তরঞ্জন নাথ। পরিবারের বাধাকে উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে নিজেই করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৪ দিন করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে গত ৭ জুন (রোববার) চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদছেন পটিয়ার হাজারও মানুষ।

জানা যায়, ডা. চিত্তরঞ্জন নাথ সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের পাচুঁরিয়া এলাকায় ‘সোশিও মেডিকেল সেন্টার’ নামের তার নিজস্ব চেম্বারে এসে অসহায় ও হতদরিদ্র মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন প্রায় তিন যুগ ধরে। অসহায়দের বিনামূল্যে ওষুধও দিতেন। কোম্পানি থেকে পাওয়া ওষুধের স্যাম্পল তিনি বিলিয়ে দিতেন এলাকার অসহায় রোগীদের মাঝে। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ এমন গরিবের বন্ধু ডাক্তারকে হারিয়ে শোকে কাতর।

ডা. চিত্তরঞ্জন নাথের পিতা নিকুঞ্জ বিহারী নাথ ছিলেন একজন কৃষক। তার চার ছেলে সন্তানদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন ছিলেন মেজ সন্তান। বাবা কৃষক হলেও সন্তানদের তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। মৃত্যুকালে ডা. চিত্তরঞ্জন দুই ছেলে স্ত্রী রেখে গেছেন। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সুমিত দেবনাথ আইটি প্রকৌশলী হিসেবে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোট ছেলে অমিত দেবনাথ কুয়েট থেকে সবেমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হয়েছেন।

হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি একজন মেধাবী ও সৎ চিকিৎসক ছিলেন। তার মৃত্যুতে পুরো হাবিলাসদ্বীপসহ আশপাশের এলাকার হাজারও মানুষকে কাঁদছে দেখা গেছে। তিনি গরিব রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন না। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যাওয়া গরিব রোগীদের ভালোবাসতেন। তিনি আমাদের পারিবারিক চিকিৎসকও ছিলেন।

এলাকার পল্লী চিকিৎসক অরুণ কান্তি শীল বলেন, এলাকার অসহায় হিন্দু-মুসলিম সবাই ডা. চিত্তরঞ্জন নাথের কাছ থেকে বিনামূল্যে সেবা পেয়েছেন। সাপ্তাহিক শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন এসে তিনি এলাকার রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। বিনা ফিতে দেখা দরিদ্র রোগীদের মাঝে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে পাওয়া ওষুধও বিলিয়ে দিতেন।

এলাকার বয়োবৃদ্ধ আফজল হোসেন বলেন, ডা. চিত্তরঞ্জন নাথ বাবু গরিবের ডাক্তার ছিলেন। তিনি মানুষের সঙ্গে এমন ভালো ব্যবহার করতেন তাতে রোগীর রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে যেতো। এমন একজন অকৃত্রিম পরোপকারী চিকিৎসককে হারিয়ে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।

সিনিয়র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দোলন বড়ুয়া বলেন, ডা. চিত্তরঞ্জন নাথ গরিব মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় আজ কদিন ধরে শুধুই স্বজন হারানোর বেদনা। তার চেম্বারের দিকে তাকালে চোখে পানি চলে আসে। মানবদরদী এ চিকিৎসক গরিব মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ায় তাকে ‘গরিবের ডাক্তার’ উপাধি দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাশঁখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নের পূর্ব চাম্বল গ্রামে। ১৯৮৪ সালে পটিয়ার পাঁচুরিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপসহকারী মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদানের পর এখানেই তিনি এ গ্রামের খেটে খাওয়া গরিব-দুঃখী মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ২০১০ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন। করোনার এ মহামারির সময়ে রমজানের শেষদিকে তার চেম্বারে একজন রোগী শরীরে জ্বর নিয়ে আসেন চিকিৎসা নিতে। এরপর থেকেই তার সহকারী সন্তোষ নাথের শরীরে জ্বর শুরু হয়। সে থেকেই তিনিও বাসায় থাকেন। কিন্তু গত ৪ জুন (বৃহস্পতিবার) তার শারীরিক অবস্থা খারাপ দেখে পরিবারের লোকজন তাকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান। সেই হাসপাতালেই তার চিকিৎসা চলছিল। এর মধ্যে অবস্থার অবনতি ঘটলে ৬ জুন শনিবার তাকে আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) নেওয়া হয়। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ৭ জুন (রোববার) সকাল সাড়ে ৭টায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর পর তার শরীর থেকে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ডা. চিত্তরঞ্জন নাথ ১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাঁশখালীর চাম্বল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। চাম্বল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে এসএসসি এবং নোয়াপাড়া কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। সেখানে এক বছর পড়াশোনা করার পর তৎকালীন সরকার ডিএমএফ কোর্স চালু করে। তখন তিনি ১৯৭৭ সালে ভর্তি হন নোয়াখালী ডিপ্লোমা মেডিকেল কলেজে। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনস্থ মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ থেকে এমপিএইচ ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছোট ভাই প্রকৌশলী আশুতোষ নাথ বলেন, ‘আমার ভাই জীবনে কোন দিন রাগ করতো না। দেশে যখন করোনার প্রাদূর্ভাব শুরু হয় তখন তাকে আমরা চেম্বারে না যাওয়ার জন্য বারণ করার পরও তিনি বলতেন আমি এতোদিন এলাকার মানুষের পাশে ছিলাম, আর এখন এ দুঃসময়ে যদি তাদের পাশে না থাকি তাহলে কেমন হবে। তিনি রোগীদের কথা চিন্তা করে নিয়মিত চেম্বারে এসেছিলেন। তিনি আমাদের সবসময় সহযোগিতা পরামর্শ দিয়ে আগলে রাখতেন। আজ আমরা তাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি।’

এদিকে ডা. চিত্তরঞ্জন নাথের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। শোকবার্তায় তিনি বলেন, এই মহৎপ্রাণ চিকিৎসক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেছেন। দেশ ও জাতি তার এই ত্যাগ মনে রাখবে।

এসএ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!