চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন/ গরিবের জন্য ফ্ল্যাট বানিয়ে দখলে নিল নিজেরাই

রোববার 'নতুন অফিসে' বসবেন মেয়র আ জ ম নাছির

পাহাড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত ভবন দখল নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। হঠাৎ এমন উল্টে যাওয়ার কারণ হিসেবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বস্তিবাসীদের পক্ষে সম্ভব ছয় লাখ টাকা করে দেওয়া?’

গত মঙ্গলবার (১৮ জুন) রাতে নগরীর টাইগারপাস এলাকায় নির্মিত ওই ভবনে আন্দরকিল্লাস্থ নগর ভবনের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে চসিক। এরও প্রায় এক মাস আগে থেকে টাইগারপাসের বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত ভবনে অফিস করছেন চসিকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ একেএম রেজাউল করিম। বর্তমানে অন্যান্য মালামাল ওই ভবনে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে পুরোদমে। রোববার (২৩ জুন) থেকেই বস্তিবাসীর ভবনে অফিস করবেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তবে বস্তিবাসীর জন্য নির্মিত ভবন অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা ‘অনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নতুন নগরভবন নির্মাণের কোন বন্দোবস্ত হওয়ার আগেই টাইগারপাসের ভবনে ঠাঁই নিচ্ছে চসিক। এর ফলে নতুন ভবনে উঠা স্বপ্নই থেকে গেল বস্তিবাসীদের।’

বিষয়টি স্বীকার চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এক মাস আগ থেকেই টাইগারপাসে নির্মিত ভবন অফিস করছেন প্রধান পরিকল্পনাবিদ একেএম রেজাউল করিম। গত মঙ্গলবার রাতে নগর ভবনের মালামাল ওই ভবনে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী রোববার থেকে ওই ভবনে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন অফিস করবেন। এর মধ্যে অন্যরাও ওই ভবনে উঠে যাবে।’

বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত ভবনটিতে ২৫০ বর্গফুট আয়তনের ১৬১টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়।
বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত ভবনটিতে ২৫০ বর্গফুট আয়তনের ১৬১টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়।

যাদের জন্য ভবন নির্মিত হলো সেই বস্তিবাসীদের কী হবে প্রশ্ন করা হলে মো. সামসুদ্দোহা বলেন, ‘ওই ভবন থেকে চলে আসার পর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

জানা যায়, প্রবল বর্ষণে ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ধসে ১২৭ জন নিহত হয়। ওই ঘটনার পর বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড়ে মৃত্যু ঠেকাতে ৩৬ দফা সুপারিশ পেশ করে। সুপারিশগুলোর মধ্যে একটি ছিল পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করা। এর দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের। সুপারিশের আলোকে ভবনটি নির্মাণ করেছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও নাগরিক সমাজের দাবির মুখে ২০১০ সালে বাটালী পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে ২০১৩ সালে বড় ধরনের বাধা ছাড়াই বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩৩ জন বস্তিবাসীর কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি ও হলফনামা নেয় সিটি করপোরেশন। তখন প্রতি ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয় ছয় লাখ টাকা। অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতিজন থেকে এককালীন নেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। মাসিক আড়াই হাজার টাকা কিস্তিতে এই মূল্য পরিশোধ করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল বস্তিবাসীদের। ২০১৩ সালে টাইগারপাসে ১২ কাঠা আয়তনের নিজস্ব জায়গার ওপর ভবন নির্মাণকাজ শুরু করে সিটি করপোরেশন। সাততলা ভবনটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ছয় কোটি ৯৯ লাখ ৪৩ হাজার আট টাকা। ভবনটিতে ২৫০ বর্গফুট আয়তনের ১৬১টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মঞ্জুরুল ইসলাম চৌধুরী।

গত ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে ভবনটি পরিদর্শন করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এ সময় বস্তিবাসীকে সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।

জানতে চাইলে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘রোববার টাইগারপাসে নির্মিত ভবনে অফিস করছি কিনা এখনও জানি না। কাজ কতটুকু হয়েছে দেখতে হবে।’

বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়জনকে পুনর্বাসন করবো? মেয়র এম মনজুর আলমের সময় ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছিল। সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য এমন কাজ করা হয়েছিল। বস্তিবাসীদের পক্ষে সম্ভব ছয় লাখ টাকা করে দেওয়া? এখন বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হচ্ছে।’

বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত ভবন সিটি কর্পোরেশনের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা অনৈতিক, অসামাজিক ও পরিবেশসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘কেন একজনের জন্য নির্মিত ভবন অন্যজনে ব্যবহার করবে? অনিয়ম ও অনীহায় ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবন নির্মাণ করা চসিকের কাজ নয়। তাদের কাজ জায়গা দেওয়া। বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত ভবনে চসিকের যাওয়া মানে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এভাবে স্থানীয় সরকার চলতে পারে না। স্থানীয় সরকারের উচিত এটা তদারক করা। চসিক মনে করেছে, বস্তিবাসীরা এটা ভুলে যাবে। বস্তিবাসীরা সংঘবদ্ধ নয় বলে চসিক এমন কাজ করতে পারছে।’

এদিকে নগর ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ২০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গত এপ্রিল মাসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে চসিক। এর আগে ২০১৭ সালে নগর ভবন নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল চসিক। মন্ত্রণালয় সেটি বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে গত বছরের ৫ আগস্ট নতুন নগর ভবন নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে একটি দাপ্তরিকপত্র দেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

নতুন নগর ভবন নির্মাণের বন্দোবস্ত না করেই বস্তিবাসীর ভবনে উঠা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা বলেন, ‘নগর ভবন নির্মাণের ডিপিপি মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দিলে চসিক নিজস্ব অর্থায়নে নগর ভবন নির্মাণ করবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!