‘গরিত ফারিবি নি’ বলেই চবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) এক বখাটের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষার্থী। বাজার থেকে কেনাকাটা করে বাসায় ফেরার পথে খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে আসা ওই তরুণীকে যৌন হেনস্তা করা হয়।

মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

যৌন হয়রানির শিকার ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ফেসবুকে পুরো ঘটনা তুলে ধরে ওই ছাত্রী লিখেছেন, এর আগেও একাধিকবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি।

করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এলাকায় আরও কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে মিলে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে আসছিলেন।

যৌন হয়রানির আকস্মিক এই ঘটনায় হতবিহ্বল ওই ছাত্রী ঘটনার দুই ঘন্টা পর রাত নয়টায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমার সাথে একটু আগে যা হলো, তার জন্য আমি রাস্তাঘাটে চিল্লাচিল্লি করার চাইতে ভালো কোনো অপশন পাই নাই। জুতা দিয়ে গালে আচমকা চড় মারার কথাও মনে ছিল না আমার। কান এতো গরম হয়ে গেছিল।’

ওই ছাত্রী লিখেছেন, ‘সামনে পরীক্ষা, অথচ হল অফ। তাই বাসা নিয়ে থাকতে হচ্ছে আবার দুই নাম্বার গেইটে। আজ মঙ্গলবার, তাই সন্ধ্যা সাতটায় বাজারে গেছি আমি। ঠিকঠাক বাজার করে চলেও আসছিলাম। খালি রিচার্জ করাটা বাকি! হেঁটে আসছি রাস্তা দিয়ে। বাসার পাশের দোকানটায় রিচার্জ করবো ভেবে এগোচ্ছি। এমন সময় বাসার সামনের রাস্তায় একটা সাইকেল ঠিক আমার সামনে থামলো। কানের পাশে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘আআর লগে গরিত ফারিবি নি?’ সোজা বাংলায় যার মানে দাড়ায়, ‘আমার সাথে সেক্স করতে পারবা?’ আমি তৎক্ষণাৎ রিঅ্যাকশন দেখাই নাই। কান গরম হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত! আমি চুপচাপ গেলাম দোকানে, রিচার্জ নাই।’

ছাত্রীটি লিখেছেন, ‘তো ফেরত আসছি বাসায় ঢুকবো ভেবে। দেখি সে এখনও আমার জন্য দাঁড়িয়ে রাস্তায়! আমার দিকে তাকাচ্ছে, অপেক্ষা করছে। আমি তখন ভিতরে ভিতরে আগুন, অসম্ভব গা জ্বলছে, মনে মনে ভাবছি কী করা যায়! ফোনটা বের করলাম, লাইট অন করলাম। সামনে গেলাম। বললাম, এদিকে তাকান তো আপনার একটা ছবি তুলি! আপনার চেহারাটা মানুষের দেখা দরকার। একটু আগে কী বলেছেন আমাকে? আআর লগে গরিত ফারিবি নি! দাঁড়ান আপনার ছবি তুলি! আমার গলার স্বর এমনেও বড়, আরও বড় হয়ে গেছে ততক্ষণে! সে বললো, ‘আপনি কে? কী যা তা বলছেন? আমি কী বলছি! আমি কিছুই বলি নাই! আপনি চলে যান’— একদম ইনোসেন্ট টাইপ ভাব ফেইসে!’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘তারপর আমি রাগে চিল্লায়ে বলছি, মানুষ চিনেন? আমাকে বোকা পাইছেন? আমাদের যা খুশি তা বলবেন! এতোটাই সাদাসিধে মনে হয়? রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই যা খুশি বলবেন! আপনার ছবি আমি ফেসবুকে দিয়ে দেবো! ভাইরাল হয়ে যাবেন বুঝছেন! তখন করিয়েন যা করার। বাড়িতে মা বোন এগুলো শিখাইছে! দাঁড়ান ভালো করে মুখ দেখান। একটু ছবি তুলি। এতো সাহস কেমনে আসে! চড় মারার কথা ভুলে গেছি! গালিও বের হয় নাই মুখ দিয়া!’

ওই ছাত্রীর চিৎকার শুনে ততোক্ষণে আশেপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে ভিড় জমাতে শুরু করে। এর মধ্যেই যৌন নিপীড়ক সেই ছেলেটি সাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। ক্ষোভের সুরে ওই ছাত্রী লিখেছেন— ‘কে কী বলছে কিচ্ছু শুনি নাই! রাগে গজগজ করতে করতে বাসার ভিতরে ঢুকে গেছি। ছবি তুলতে পারি নাই ঠিকঠাক! অসহ্য লাগছে! খুব অসহ্য! এই ভ্যাজাইনা নিয়া কোথাও শান্তিতে বাঁচা যাইতেছে না। পাপ করেই আসলে মেয়ে হয়ে জন্মাইছি! এটাই ফিল হচ্ছে এখন, আর কিছু না!’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এর আগেও একাধিকবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই তরুণী। সেরকমই এক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ওই ছাত্রী বলেন, ‘একবার একটা ঘটনা ঘটলো রেলক্রসিংয়ে। শহর থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছি আমি দুইটা দাদার সাথে— নাজিরহাটের ট্রেনে করে। ট্রেন থেকে নেমে রেলক্রসিংয়ে মোটামুটি ভীড় হয় সবসময়। আমরা অপেক্ষা করছিলাম সিএনজির জন্য। ওই সময় একটা হাই স্কুলপড়ুয়া ছেলে হবে সম্ভবত। আমার ডান পাশের পেট থেকে কোমড়ের নিচে অবধি পিছন দিয়ে ছুঁয়ে হেসে হেসে চলে যাচ্ছিল। আমি খপ করে হাতটা ধরে ফেলেছি সাথে সাথে। জুতা খুলে চড় মারতে যাবো, ঠিক তখন দৌড় দিয়ে হাত ছুটিয়ে চলে গেল ভীড়ের মধ্যে। আমি পিছন পিছন গেছি, কিন্তু নাগাল পাইনি। চিল্লাচিল্লি করেছি ওখানে। লোক জড়ো হয়ে ছোটখাটো একটা সিনক্রিয়েট হয়ে গেছে! ওইটা মনে পড়লে এখনো অসম্ভব রাগ হয় আমার!’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে— এমন অভিযোগ তুলে কলা অনুষদের এই ছাত্রী লিখেছেন, ‘আমরা আদিবাসী মেয়েরা মূলত অধিকাংশই ক্যাম্পাসের দুই নাম্বার গেইটের দিকে বাসা নিয়ে থাকি। এটা একটা পরম্পরা বা প্রথা টাইপের হয়ে গেছে বলতে পারেন। জুনিয়ররা আসে, আর সিনিয়র দিদিরা হলে সিট পেয়ে চলে যান। পাশেই জোবরা গ্রাম। প্রতি শনি-মঙ্গলবার এখানে বাজার বসে‌। চবির একটা অঘোষিত নিয়ম হলো একাডেমিক কোনো কাজ ছাড়া, ঘুরে বেড়ানো, বাজার সদাই— যাই হোক সব বিকেল বা সন্ধ্যা টাইমেই সবাই করে।’

তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম দিকে আমরা যখন ছিলাম সেই ফ্রেশার টাইমে, জোবরা গ্রামের পিচ্চি পিচ্চি ছেলেগুলো, কতো আর হবে বয়স, বড়জোর আট-দশ-বারো! ছেলেপুলেগুলো আমাদের রাস্তাঘাটে যেখানে পেতো আজেবাজে টিজ করে চলে যেতো। আমি জানি না আমাদেরকে এতো নিরীহ কেন দেখায়! আমাদের রক্তে চুপচাপ শুনে যাওয়ার স্বভাব কেন! কেন আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না! মাঝে মাঝে সেসব টিজ গায়ে মাখতাম না আমি, আর মাঝে মাঝে কটা কথা অবশ্যই শোনাতাম! পিচ্চিগুলা আমাদের ভাষার কয়টি গালি কোত্থেকে শিখেছে আল্লাহ মালুম! সেন্ট্রাল ফিল্ডে খেলতে যাওয়ার সময় আমাদের আদিবাসী মেয়েদের বাসার সামনে এলে টিজ, যাওয়ার সময়ও টিজ।’

ওই ছাত্রী আরও লিখেছেন, ‘আজেবাজে কথা! লাইটলি নেই নাই তেমন কখনও। ছেলেমানুষ ভেবে যেতে দিছি! আরেকটা বিষয় হলো, দুই নাম্বার গেইটের বাজারের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যে চোখগুলো আমি প্রতিনিয়ত দেখি তা বর্ণনাতীত। মনে হয় চোখগুলো আমাকে গিলে খাচ্ছে, ধর্ষণ করে ফেলছে চোখ দিয়া, আমি একটা আস্ত চিড়িয়া! এসবও গায়ে মাখিনি তখন, এখনও মাখি না।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থীই বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না— এমন অভিযোগ অনেকেরই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে আসা চবিরই আরেক ছাত্রী এমন ঘটনার শিকার হয়ে বিচার চাইতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে। কিন্তু ঘটনাস্থল ক্যাম্পাসের বাইরে— এমন যুক্তি দেখিয়ে এ ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই ছাত্রী বললেন, ‘আমরা প্রক্টর বরাবর পর্যন্ত গেছিলাম এই ২নং গেটের এসব ঘটনায় অসহ্য হয়ে। কিন্তু প্রক্টর কিছুই করতে পারেনি কারণ সেটা ক্যাম্পাসের বাইরে। স্থানীয়দের রাজত্ব সেটা। আর তারা পাহাড়ি মেয়েদের মানুষ না ভোগ্যপণ্য মনে করে। সেখানে থাকাকালীন যে অবস্থার ভিতর থাকতে হয়েছে, তা মনে পড়লে এখনো রাগে গা জ্বলে আমার। মনে হয় খুন করে ফেলতে পারব হাতে পেলে।’

এ বিষয়ে সবশেষ মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) যৌন হেনস্তার শিকার ওই শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এই ধরনের প্রতিনিয়তই ঘটছে। আমরা এর বিচার পাচ্ছি না। এখন একা বের হতে ভয় লাগে। এই ঘটনার বিচার চেয়ে প্রক্টর স্যারের কাছে অভিযোগ করবো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূইয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কোন ঘটনার কথা শুনি নাই। কেউ অভিযোগও করে নাই। অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।’

এমআইটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!