গরমের শুরুতে চট্টগ্রামে শিশুরা কাবু ব্রংকিওলাইটিসে, ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে

গ্রীষ্মের শুরুতে চট্টগ্রামে বাড়ছে শিশুদের রোগ। প্রতিদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে রোগী। ভাইরাস ফিভার থেকে শিশুরা ব্রংকিওলাইটিস ‍ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুর বয়স এক বছর পর্যন্ত ব্রংকিওলাইটিস হতে পারে। কিন্তু দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয় না। দুই বছর পর্যন্ত যেসব শিশু বারবার ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ভোগে, ধরে নেওয়া হয় তাদের ব্রংকিওলাইটিস সমস্যা রয়েছে। তবে শিশুকে দেখে অসুস্থ কিংবা শরীর কালচে মনে হলে দেরি না করে হাসপাতালে নেওয়া উচিত।

সাধারণত রেস্পিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগ হয়। এতে বায়ুনালিতে প্রদাহ হয়ে ফুলে যায় এবং মিউকাস দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে শিশুর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যার সৃষ্টি করে। আনুপাতিকভাবে শিশুদের নিউমোনিয়ার (১১ শতাংশ) চেয়ে ব্রংকিওলাইটিস (২১ শতাংশ) বেশি হয়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে সিট রয়েছে ১০২টি। কিন্তু এর বিপরীতে প্রায় তিনগুণ শিশু রোগী ভর্তি আছে। যার প্রায় বেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।

রোগের কারণ বর্ণনা দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগের আবাসিক ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. মো. সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন শিশু রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ জন নিউমোনিয়ার রোগী থাকছে, যাদের ওয়ার্ডে ভর্তি দিতে হচ্ছে। এছাড়া ১৫ থেকে ২০ জন ব্রংকিওলাইটিসে আক্রান্ত শিশুও আসছে প্রতিদিন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে ওয়ার্ডে ভর্তি দিলেও বাকিদের নির্দেশিকা অনুযায়ী বাসায় চিকিৎসা নিতে বলা হচ্ছে।’

তিনি রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিশুর বয়স এক বছর পর্যন্ত ব্রংকিওলাইটিস হতে পারে। কিন্তু দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয় না। দুই বছর পর্যন্ত যেসব শিশু বারবার ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ভোগে, ধরে নেওয়া হয় তাদের ব্রংকিওলাইটিস সমস্যা রয়েছে। ব্রংকিওলাইটিস হলে শিশু ঠাণ্ডা-কাশি আর অল্প শ্বাসকষ্টে ভুগলেও সেই অর্থে অসুস্থ মনে হয় না। প্রাথমিকভাবে শিশুর হাসি ও কাশির সময় বুকে বাঁশির মতো শব্দ হচ্ছে কি-না তা দেখে বুঝতে হবে, শিশুর নিউমোনিয়া নাকি ব্রংকিওলাইটিস হয়েছে। এতে আক্রান্ত শিশুর সাধারণত তেমন জ্বর থাকে না, হলেও কম তাপমাত্রা থাকে। অন্যদিকে শিশু যদি না হাসে, দেখেই কিছুটা অসুস্থ মনে হয়, তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা যায়, তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশুর ব্রংকিওলাইটিসের জন্য প্রকৃতপক্ষে আলাদা করে তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ থেকে সাতদিনের মধ্যেই শিশু সুস্থ হয়ে যায়। তবে শিশুকে দেখে অসুস্থ কিংবা শরীর কালচে মনে হলে দেরি না করে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। তবে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা উচিত না। শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি হলে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারও খাওয়াতে হবে।’

এদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহিম হাসান রেজা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিদিন শিশু হাসপাতালে যেসব রোগী আসছে তার ১০০ জনের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জনই নিউমোনিয়ার রোগী। এখানে প্রতিদিন আইসিইউ মিলে প্রায় শ’ তিনেক শিশু রোগী ভর্তি থাকছে। শীতের শেষে শিশুদের এই রোগের প্রকোপ আবারও বেশি দেখা দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে শিশুদের জ্বর, সর্দি থাকছে। তারপর চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে, চোখে ময়লা জমছে। এরপর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। বাচ্চা যখন বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেবে, তখনই বুঝতে হবে বাচ্চা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। দেরী না করে বাচ্চাকে হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯ নম্বর শিশু ও ৩২ নম্বর নবজাতক ওয়ার্ডের বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দা হুমায়দা হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গড়ে প্রতিদিন ৫০ জন নবজাতক ভর্তি আছে। এর অর্ধেক নবজাতক লেট অনসেট সেপসিস (lons) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। ওয়ার্ডে মোট ভর্তি নবজাতক ১৬০ থেকে ১৮০ জন।’

তিনি বলেন, ‘সর্দি, ফ্লু বা অন্যান্য সংক্রমণ রয়েছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে শিশুকে আলাদা রাখতে হবে। বাচ্চাকে সময়মতো টিকা দিতে হবে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯ নম্বর শিশু ও ৩২ নম্বর নবজাতক ওয়ার্ডের বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জগদীশ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় কিছু ক্রাইটেরিয়া মানতে হয়। যদি ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়া হয়, তখন অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার হয়। ওষুধগুলো সময়মতো প্রয়োগ করতে হবে, যা শিশুকে দ্রুত সুস্থ হতে এবং সংক্রমণ রোধ করতে সহায়তা করবে। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় কমপক্ষে একবার তাপমাত্রা দেখতে হবে। তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘শিশুর বয়স যদি তিন মাসের কম হয়, যদি একেবারে খাওয়া ছেড়ে দেয় ও শ্বাস নেওয়ার গতি দুই মাসের কম বয়সী শিশুর মিনিটে ৬০ বার, দুই মাস থেকে এক বছরের পর্যন্ত শিশুর প্রতি মিনিটে ৫০ বারের বেশি এবং এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মিনিটে ৪০ বারের বেশি হলে, শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের পাঁজর দেবে যায় কিংবা শিশুর ঠোঁট ও জিহ্বা নীল হয়ে যায় তখন শিশুকে অবশ্যই জরুরিভাবে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এগুলো নিউমোনিয়ার লক্ষণ।’

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বাসনা মুহুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমান সময়টি যেহেতু গরমের শুরু, শীতের শেষ—তাই ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আর সেটা থেকেই ব্যাকটেরিয়া নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে এখন নিউমোনিয়া এত খারাপ অবস্থায় যাওয়ার কারণ শিশুদের পুষ্টিহীনতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাই রোগটি সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া নিউনোমিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে।’

তিনি মায়েদের সতর্ক করে বলেন, ‘বাচ্চার জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা যাবে না। বাচ্চা যে ঘরে থাকবে সে ঘর ধুলো-বালি, জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। পাতলা জামা-কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!