গভীর রাতে গ্রাম ভেসে গেল ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে

প্রভাবশালীদের বদলে ছড়া দখলের শাস্তি পেল নিরীহ গ্রামবাসী

রাতে গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে ছিল। ঠিক রাত সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে মাটির কাঁচা ঘরের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিচ্ছিল ৪-৫ ফুট উঁচু পাহাড়ি ঢলের তীব্র বেগ। অনেকেই মনে করেছেন ডাকাত পড়েছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখেন ডাকাত নয়, দরজা ভেঙ্গে পাহাড়ি ঢল ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েছে। ঢলের প্রচন্ড বেগ ঘরের একদিকে ঢুকে অপর দিকে বের হয়ে যাচ্ছিল।

এর সাথে সাথে মাটির ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ছিল আর ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভেসে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বের হয়ে ছুটোছুটি। বসতভিটা, রাস্তাঘাট, পুকুর সর্বত্র ৫-৬ ফুট পানির নিচে ডোবা। এক বিভীষিকাময় অবস্থা।

সোমবার (৯ আগস্ট) ভোর হতে না হতে সহায় সম্বল ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। যা সম্বল ছিল তা বাঁচানোর লড়াই করছিল সবাই। ততক্ষণে পাহাড়ি ঢলের বেগ কিছুটা কমেছে।
ভয়ংকর এই পাহাড়ি ঢলের তান্ডবটি হয়েছিল গত ৮ আগস্ট মধ্যরাতে বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নের পাইরাং গ্রামে।

ওই গ্রামের পাশে নেই কোন নদী,খাল কিংবা সমুদ্র। গ্রামের মানুষের কল্পনাতেও ছিল না পাহাড়ি ঢলে গ্রামে ভয়ংকর তান্ডব হবে। এর আগে কখনও এরকম ভয়ংকর অবস্থা হয়নি। পরে জানা যায়, গ্রামের অদূরে থাকা পাহাড় থেকে রোববার রাতের টানা বৃষ্টিতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এই অবস্থা হয়েছে। এসব পাহাড়ি ঢল এর আগে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হতো।

পাহাড়ি ছড়াগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়ি নির্মাণ করায় পাহাড়ি ঢল এখন ছড়া দিয়ে নয়, মানুষের বসতভিটার ওপর দিয়ে প্লাবিত হচ্ছে।

বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ঘর-বাড়ি সহায় সম্বল হারানো মানুষগুলোর কথা শুনেছি এবং দেখেছি। তাদেরকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে। পাহাড়ি ঢলে পাইরাং গ্রামে ভয়ংকর ক্ষতি হয়েছে।
গভীর রাতে গ্রাম ভেসে গেল ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে 1
সোমবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পাইরাং গ্রামের চাটিয়া পাড়া ও হিন্দু পাড়ায় ৩২টি ঘর-বাড়ি পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে ভেঙে গেছে। কিছু কিছু মাটির ঘর খাড়া দেখালেও প্রতিটি ঘরের দেয়ালে ফাটল দিয়ে হেলে আছে। ওখানে কেউ বসবাস করলে যেকোন মুহূর্তে প্রাণহানি হবে। বসতভিটায় জমে আছে ২-৩ ফুট করে পাহাড়ি ঢল, যেখানে পানি নেই সেখানে এবং অনেকের ঘরের ভেতর ১ থেকে দেড় ফুট পলি কাদা জমে আছে।

ক্ষতিগ্রস্থরা প্রতিবেশীদের আশ্রয়ে আছে এবং প্রতিবেশীরা খাবারও দিচ্ছে সাধ্যমতো। চাটিয়া পাড়ার কৃষক আব্দুর ছালাম ও তার স্ত্রী ছাফিয়া খাতুন নিজের স্বপ্নের ঘর হারিয়ে বাড়ির উঠানে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের ঘরের ভেতর ছিল ৫০ আড়ি (১ আড়ি সমান ১০ কেজি) ধান। সব ধান ভিজে গেছে।

তারা জানান, রাত সাড়ে ৩টায় পাহাড়ি ঢল সজোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে। মনে করেছিলাম ডাকাত, পরে দেখি পানি। গজব নেমেছে মনে করে অন্য দরজা দিয়ে পালিয়ে আমরা বাঁচি। এভাবে ঘর ভাঙার ভয়ংকর দুর্দশার কথা জানালেন মো. গফুর, আবু ছৈয়দসহ অনেকে।

হিন্দু পাড়ার বাসিন্দা রতন দে, তপন দে, সাধন দাশ, লিটন দে, রাখাল দেসহ অসংখ্য ক্ষতিগ্রস্থরা বলেন, পাহাড়ি ঢলের এরকম ভয়ংকর তান্ডব হতে পারে আমরা কল্পনাও করিনি। পাহাড়ি ঢল প্রবাহিত করার ছড়াগুলো দখল করে দোকানপাট-ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ফেলায় পাহাড়ি ঢলের গতিপথ পরিবর্তন করে আমাদের গ্রামের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রশাসনের উচিত অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার।

বাঁশখালী উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা ইমরুল হক চৌধুরী ফাহিম বলেন, পাহাড়ি ঢলের কারণে পাইরাং গ্রামে পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, কালভার্ট ও রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ ক্ষতিগ্রস্থদের প্রাথমিকভাবে খাদ্য সহায়তা করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থের তালিকা করে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!