খোলা বন্ধের খেলায় হাসে করোনা, কাঁদে অর্থনীতি

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী এখনও তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। দিন দিন বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে একদিনে শনাক্ত সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আবার কোনো দিন থাকছে হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় জনসচেতনতার ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটির মধ্যেই সীমিত আকারে দোকানপাট, শপিংমল এবং মসজিদ খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শর্তসাপেক্ষে বাস্তবতার নিরিখে যদিও এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। এজন্য বাড়ছে ভাইরাস বিস্তারের ঝুঁকি।

করোনাভাইরাস বলে কিছু একটা আছে; অনেকেই তা ভুলে কারণে-অকারণে রাস্তায় নেমে পড়েছে। বিশেষ করে মাসখানেক পর যখন রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো খোলার ঘোষণা দেওয়া হলো, তার কিছুদিন পর খুলে দেওয়া হলো দোকানপাট-শপিং মল; এই সুযোগে বেড়ে গেলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।

এদিকে চট্টগ্রামের করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকির আশংকায় সকল মার্কেট ও বিপনী বিতান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে দেখতে পাই, দেশের মানুষের একটি বড় অংশ মাস্ক পরছেন না, সামাজিক দূরত্ব মানছেন না, প্রয়োজন ছাড়াই রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করছেন। দোকানপাট-বাজার-হাটে নিয়মের মানার কোনো বালাই নেই। আগের মতোই ভিড়, জটলা করে মানুষ কেনাকাটা করছেন। রমজান মাস বিধায় কেনাকাটায় আগের জৌলুস ফিরে এসেছে। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ইচ্ছেমত দরে। মুরগি-মাছেও দর বেড়েছে। কারণ এসব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনা উত্তর সময়ে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। বাড়বে দারিদ্রতা, বন্ধ হবে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, চাকরি হারাবে লাখ লাখ মানুষ। দারিদ্র্য-পীড়িত বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের শঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
খোলা বন্ধের খেলায় হাসে করোনা, কাঁদে অর্থনীতি 1
সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। গ্রহণ করতে হবে যথাযথ পরিকল্পনা। এবং সেই পরিকল্পনা শুরু করতে হবে এখনই। এই মুহূর্তে মানবসম্পদ বাঁচানোর জন্য প্রযোজ্য সবাইকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছাতে হবে। তা অব্যাহত রাখতে হবে যতদিন তারা স্বাভাবিক আয়-উপার্জনের অবস্থায় ফিরে না আসে। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনমতো খাদ্যসামগ্রী নিয়মিত পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনা হতে হবে নিশ্ছিদ্র ও দুর্নীতিমুক্তভাবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। এতে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷

প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দেওয়ায় তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারছেন না৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে৷ কমে গেছে বেচাকেনা৷ চাহিদা কমে যাওয়ায় পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতির মুখে পড়তে শুরু করেছে৷

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ানো, সেটা কিন্তু নয়। সুতরাং, লম্বা সময়ের জন্য অর্থনীতির চাকা বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনীতি তলানীতে যেয়ে ঠেকবে। সেখান থেকে উত্তরন ঘটাতে আবার নতুন করে আমাদের সব শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হবে রাষ্ট্রকেও।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকেরা। এরা স্বল্প বেতনে আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই সমাজকে টিকিয়ে রাখতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণী আর্থিক সংকটে রয়েছে। যদি আমরা অর্থনীতির গতিকে সংকট-পরবর্তী সময়ে ত্বরান্বিত করতে চাই তাহলে এই মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণীকে আর্থিক বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে।

আমাদের প্রথম টার্গেট হওয়া উচিত, মানুষকেও বাঁচাতে হবে, অর্থনীতির চাকাও সচল রাখতে হবে। ঈদ পরবর্তী সময়ে সাধারণ ছুটি যদি আরও দীর্ঘ হয় তাহলে অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।

বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, তাতে আগামী এক বছরে এর উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। যাতে বেকার শ্রমিকরা দ্রুত কাজ পান।

মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে দেশের জনশক্তি বাজার এবং সেখানে কর্মরত প্রবাসীদের চাকরির সুরক্ষায় তৎপরতা চালাতে হবে।

আমরা যদি মনে করি, এখন করোনা মোকাবেলা করি, অর্থনীতি নিয়ে পরে ভাবা যাবে- তাহলে তা ভুল হবে। এখনই অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়তে থাকলে অর্থনীতিতে ধস নামবে। এটার প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে।

এখন কোন অবস্থাতেই জীবন আর জীবিকাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। কম করে হলেও আমাদেরকে নিয়ম মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেতে হবে। তবে তাড়াহুড়ো না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনের দিকে যেতে হবে। এই সময়ে মানুষের জীবন রক্ষা করার পাশাপশি অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তাই আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলার সময় এবং করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কথা না মেনে উপায় নেই যে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ শারীরিকভাবে যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে তার চাইতে করোনার সময়ে আয়-উপার্জনহীন হয়ে, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আর্থিক সংকটে তার চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যক্তি ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য করোনা তাই বড় হুমকি।

অবকাঠামোতেই বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তারা উদ্ভাবক দেশে এবং বিদেশে ভার্চুয়াল অর্থনীতিতে সফলতার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে। অতএব মনোযোগ প্রয়োজন এখানেও।

ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সমষ্টিগত স্বার্থ বিবেচনায় আমাদের সকল কর্ম পরিচালিত হবে- এই স্লোগান নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে, দুর্যোগ শেষে খুব তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশ।

লেখক : চেয়ারম্যান, এলবিয়ন গ্রুপ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!