খেলোয়াড় বনাম বিসিবির লড়াইয়ে ‘আম্পায়ার’ হবেন কে?

পদত্যাগ করবেন না দুর্জয়, সাকিবদের পাশে ফিকা

খেলোয়াড়রা মাঠে প্রতিপক্ষের সাথে খেলেন। বোর্ডের কাজ হচ্ছে সেই খেলা আয়োজন ও খেলোয়াড়দের ভাল-মন্দ দেখাশুনা করা। অর্থাৎ খেলোয়াড়দের ক্রিকেট সংসারের অভিভাবক হচ্ছে বোর্ড। পরিবারের বাবা-ছেলের মধ্যে কোন সমস্যা দেখে দিলে নিজেরা সমাধান করতে না পারলে সমাধানে এগিয়ে আসেন পরিবারের কোন এক মুরব্বি। নিজেদের পরিবারে মধ্যস্ততা করার মতো কেউ না থাকলে পাশের বাড়ির কেউ একজন এসে সমাধান দিয়ে যান। বাংলাদেশের ক্রিকেটের খেলোয়াড়-বিসিবি সমস্যার সমাধানে কে হবেন সেই মুরব্বি? মাঠের লড়াইয়ের সময় যেভাবে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মেনে নেন খেলোয়াড়রা, দেশের ক্রিকেট সংকটে এখন কে হবেন ‘আম্পায়ার’ সেই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে।

১১টি দাবি-দফা নিয়ে ক্রিকেটাররা সোমবার ধর্মঘট ডেকে বসলো! জানিয়ে দিলো, দাবি না মানা পর্যন্ত তারা কোনো ধরনের ক্রিকেটই খেলবে না, ক্যাম্পে যোগ দেবে না। অথচ, সামনেই ভারত সফর। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এই প্রথম ভারতে কোনো পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এই সিরিজ দিয়ে শুরু হবে বাংলাদেশের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। চলছে জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল), কিছুদিন পরে রয়েছে বিপিএল।

এই সময়ে এসে ক্রিকেটারদের এই আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি মনে করছেন, এটা ষড়যন্ত্র। পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। ক্রিকেটাররা যেভাবে তাদের দাবিগুলো উত্থাপন করেছে, সেটা ছিল নিশ্চিত একটা ভুল। কারণ, প্রথমে যদি তারা বিসিবির কাছে গিয়ে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতো, এরপর বিসিবি যদি না মানতো, তখন তারা আন্দোলনে যেতে পারতো। ধর্মঘটের ডাক দিতো। কিন্তু বিসিবিকে না জানিয়ে সরাসরি মিডিয়ার সামনে গিয়ে তাদের ১১ দফা দাবি তুলে ধেরেছে এবং ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।

জবাবে মঙ্গলবার বিসিবিতে প্রায় দু’ঘণ্টার সভা শেষে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বে যা বলা হলো, তাতেও উদ্ভূত পরিস্থিতি ইতিবাচক সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বোর্ড সভাপতি তার দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনের শেষে এটুকু বলে শেষ করলেন, ‘তারা (আন্দোলনকারী ক্রিকেটাররা) আসলে দরজা খোলা আছে। তারা বসলে কথা বলবো।’ পাপন অভিযোগ করেন, দু-একজন ক্রিকেটার টেলিফোন করলেও নাকি ফোন কেটে দিচ্ছে তারা। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তারা আসেনি আমাদের কাছে। দু’তিনজনকে ফোন করা হলেও তারা ফোনও রিসিভ করছে না। ক্রিকেটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। কিছু মিডিয়াও আছে। একটা লোক আছে যে মিথ্যা কথা বলে, আমি তিনবার প্রমাণ করলাম সে মিথ্যা কথা বলে। কিস্তু তাকে নিয়েই ফোকাস।’

ক্রিকেটার এবং বিসিবি- দুপক্ষেরই বক্তব্য এলো মিডিয়ার সামনে। বোঝাই যাচ্ছে, দু’পক্ষই এখন মুখোমুখি। দু’পক্ষের ভাবটাই এমন- আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি আমাদের দাবি। ক্রিকেটাররা বলছে বোর্ড যা করার করুক। বিসিবি বলছে, খেলা বন্ধ করে তো কিছু দাবি পেশ করা যায় না। মঙ্গলবার বিকেলে বোর্ড প্রেসিডেন্টের কথা শুনে মনে হলো- তিনিও অনড়। তার বক্তব্য, আগে ক্রিকেটাররা তাদের কাছে আসুক। তারপর সমাধানের প্রশ্ন।’ অর্থ্যাৎ একটা ‘ইগো’ তৈরি হয়েছে দু’পক্ষের মধ্যেই।

এ অবস্থায় উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান করতে একটা মধ্যস্থতা দরকার। তাহলে এই মধ্যস্ততাকারী কে? সমাধান আসবে কার মাধ্যমে? তবে কি বাংলাদেশের অন্য শত শত সমস্যা সমাধানের মত- এই সমস্যা সমাধানের জন্যও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে? পরিস্থিতি যা, অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়াতে পারে ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ডের এই সমস্যা।

তবে, পাপনের সংবাদ সম্মেলনের পর ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) জানিয়েছে, ‘আমরা কোয়াবের পক্ষ থেকে প্রস্তুত, আমাদের কাছে আসলে আমরা মধ্যস্ততা করতে রাজি আছি।’ কিন্তু ক্রিকেটারদের ১১ দাবির একটি দাবিতো বর্তমান কোয়াব নেতাদের পতত্যাগ। তাহলে তারা কেমনে

পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না : কোয়াব সভাপতি দুর্জয়

খেলোয়াড়দের দাবি থাকলেও পদত্যাগ করবেন না বলে জানালেন কোয়াব সভাপতি নাঈমুর রহমান দুর্জয়
খেলোয়াড়দের দাবি থাকলেও পদত্যাগ করবেন না বলে জানালেন কোয়াব সভাপতি নাঈমুর রহমান দুর্জয়

যে ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটাররা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে তার প্রথমটিতেই রয়েছে কোয়াবের নেতৃত্ব নির্বাচন। ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতৃত্ব নির্বাচন করবে ক্রিকেটাররাই। বোর্ড নির্ধারিত কেউ এখানে আসতে পারবে না। ক্রিকেটারদের এমন দাবি ওঠার পরই আলোচনায় চলে আসে কোয়াবের কমিটির বিষয়টি। শুধু তাই নয়, সোমবার থেকেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, কোয়াবের সভাপতি, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বর্তমান বিসিবি পরিচালক নাঈমুর রহমান দুর্জয় পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন।

কিন্তু মঙ্গলবার বিকেলে ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের ইস্যুতে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মিডিয়া ব্রিফিংয়ের পর সংবাদ সম্মেলন করে কোয়াবও। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কোয়াব সভাপতি নাঈমুর রহমান দুর্জয় এবং সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল। সংবাদ সম্মেলনেই দুর্জয় জানিয়ে দেন, কোয়াব থেকে আমার পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, ‘আমি বলছি, নির্বাচন আসুক আগে। সেখানে যার সমর্থন সবচেয়ে বেশি, যাকে ক্রিকেটাররা চাইবে- তাকেই নির্বাচিত করবে। সেখানে আমি হই কিংবা অন্য যে কেউ হোক- হতে পারে। অথচ কেউ কেউ বলছে, আমি নাকি পদত্যাগ করছি। কিন্তু এটা ভুল। আমি পদত্যাগ করছি না।’ দুর্জয় বলেন, তারা এখনও ক্রিকেটারদের জন্যই লড়ছেন।

দুর্জয় জানান, ধর্মঘট কিংবা ক্রিকেটাররা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এবার আর কোয়াবের কারো কাছে আসেনি। তিনি বলেন, ‘প্লেয়াররা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সব সময়ই আমাদের কাছে আসতো; কিন্তু এবার আমাদের কাছে আসেনি তারা। তাদের এসব বিষয় নিয়ে আমরা কিছুই জানতাম না।’

সংবাদ সম্মেলনে শেষে কথা বলতে গিয়ে নাঈমুর রহমান দুর্জয় বলেন, ‘কোয়াব প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, বোর্ড পরিচালক হিসেবেও নয়, দিন শেষে আমিও জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার, অধিনায়ক। যারা দাবি-দাওয়া পেশ করেছে তারাও বর্তমান জাতীয় দলের ক্রিকেটার। হয়তো বা তারা আমার চেয়ে বড় স্টার। তবে আমরা উভয়ই দেশের জন্য খেলেছি এবং সেটা বাংলাদেশের জন্য। অন্য কোনো দেশের জন্য নয়। আমি কোনো কাদা ছোঁড়াছুড়ি চাই না। বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য চলুক, সেটাও কাম্য নয়। তাতে তিক্ততাই বাড়বে শুধু। পরিস্থিতির একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান অবশ্যই কাম্য। কোয়াবের পক্ষ থেকে প্রস্তুত আমাদের কাছে আসলে আমরা মধ্যস্ততা করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।’

ক্রিকেটারদের আন্দোলনে ফিকার সমর্থন
খেলোয়াড় বনাম বিসিবির লড়াইয়ে ‘আম্পায়ার’ হবেন কে? 1
বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের আন্দোলনের সমর্থনে জানিয়েছে ক্রিকেটারদের প্রতিনিধিত্ব করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘দ্য ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনস (ফিকা)। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সাকিব-তামিমদের আন্দোলনকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি খেলোয়াড়দের একতা এবং একসাথে অবস্থান নেয়ার প্রশংসা করে সংস্থাটি।

১৯৯৮ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সকল জাতীয় খেলোয়াড়দের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত পেশাদার ক্রিকেটারদের কার্যক্রমকে সমন্বয় সাধন করাই এ সংস্থার প্রধান কাজ। ফিকা’র মাধ্যমেই ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ক্রিকেট প্লেয়িং কমিটিতে’ খেলোয়াড়দের সমস্যাবলী তুলে ধরা হয়।

সোমবার ১১ দফা দাবির কথা জানিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়ার পর মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেটারদের আচরণ ও ধর্মঘটে বিস্ময় প্রকাশ করেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন। তিনি আর্থিক কারণে আন্দোলনে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানান। এছাড়া আন্দোলনকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন পাপন। ফলে ক্রিকেটার ও বোর্ড সভাপতির মুখোমুখি অবস্থানে ঘোলাটে হচ্ছে পরিস্থিতি। সংশয় তৈরি হয়েছে আসন্ন ভারত সফর ও বিপিএল অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে। এর মধ্যেই খেলোয়াড়দের সমর্থনে বিবৃতি দিল ফিকা।

বিবৃতিতে ফিকার নির্বাহী চেয়ারম্যান টনি আইরিশ বলেন, ‘পেশাদার ক্রিকেটার হিসাবে তাদের ন্যায্য সুরক্ষা নিশ্চিতে খেলোয়াড়দের একতা এবং একসাথে অবস্থান নেয়াকে প্রশংসা করছে ফিকা। বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের এক হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও এটি ঘটেছে। আমরা বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট দেশ হিসাবে যা বিবেচনা করি, তাতে খেলোয়াড়দের সাথে যেভাবে আচরণ করা দরকার, এটা সেই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।’

‘আমাদের কাছে এটাও স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ারকে প্রভাবিত করে এবং তাদের জীবিকা নির্বাহ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বিষয়ে শ্রদ্ধা বোধ করে না। খেলোয়াড়দের কণ্ঠ ও সম্মিলিত প্রতিনিধি ‘প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা আমাদের কাছে উদ্বেগের। কারণ ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিডব্লিউএবি) তাদের ভূমিকা পালন করে না বলে মনে হয়। খেলোয়াড়দের জন্য এটা খুব জটিল সময়। এটি আরও উদ্বেগের বিষয় যে, দেখে মনে হয় সিডব্লিউএবির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পদে রয়েছেন’-,যোগ করেন ফিকা চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনে সমর্থন দেয়া গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ইস্যুগুলোর সম্মিলিত প্রকৃতি দেখে আমরা বিশ্বাস করি, এই সময়ে খেলোয়াড়দের সমর্থন এবং সহায়তা দেয়া ফিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!