খুলনায় প্রেম, চট্টগ্রামে লিভটুগেদার, অতঃপর তরুণীকে খুন

৬ বছর আগের ট্রাঙ্কবন্দি লাশের রহস্য উদঘাটন

চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ঈগল পরিবহনের বাসটি ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পর বাসের বক্সে একটি ট্রাঙ্কে মেলে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ। ছয় বছর আগের সেই ঘটনার কোনো ক্লু ছিল না, কোনো হদিসও বের করতে পারছিল না পুলিশ। শেষ পর্যন্ত টানা দুই বছর তদন্ত চালিয়ে সেই রহস্যের কিনারা করতে সক্ষম হল পিবিআই— পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন।

শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ভোরে এ ঘটনার মূল আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে কুমিল্লার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। স্বপন নৌ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য। অন্যদিকে অজ্ঞাত সেই নারীটি হলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকায় বসবাসকারী শম্পা বেগম।

পিবিআই জানিয়েছে, ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট কেটে এক ব্যক্তি বাসের বক্সে একটি ট্রাঙ্ক তুলে দেন। বাসের হেলপারকে বলেন, সামনের ভাটিয়ারি কাউন্টার থেকে টিকিটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে সেরকম কোনো যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গাবতলীতে পৌঁছায়।

শেষ গন্তব্যে সব যাত্রী তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। এরপর হেলপার দেখেন, বাসের বক্সে একটি ট্রাঙ্ক মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসের ড্রাইভার-হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি নামিয়ে দেখেন, সেটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুসসালাম থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ পান। এরপর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। লাশের পরিচিতি শনাক্ত না হওয়ায় পরে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ হিসেবে সেটি দাফন করা হয়। কেউ বাদী না হওয়ায় থানা পুলিশের পক্ষে এসআই জাহানুর আলী বাদী হয়ে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে দারুস সালাম থানায় (মামলা নং-০৬ তারিখ ০৩/০৫/২০১৫ ইং, ধারা ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড) মামলা দায়ের করেন।

খুলনায় প্রেম, চট্টগ্রামে লিভটুগেদার, অতঃপর তরুণীকে খুন 1

মামলাটি হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ তদন্ত করে। এরপর সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে সিআইডি। রিপোর্ট গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেয়। পিবিআই ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) ইউনিট ইনচার্জ মো. জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তদন্ত কর্মকর্তাকে সশরীরে চট্টগ্রাম এবং ওই জেলা এলাকার সব থানায় ২০১৫ সালে এন্ট্রিকৃত নিখোঁজ জিডিসমূহ অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠান পিবিআই ডিআইজি। তদন্ত কর্মকর্তা এক সপ্তাহ পরিশ্রম করে ওই সময়ে কাছাকাছি প্রায় ১০-১২টি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করেন। ওই জিডিগুলোর মধ্যে একটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে তরুণী নিখোঁজের (জিডি নং-৫৯৯, তারিখ ১০/০৬/২০১৫ ইং মূলে দেখা যায় শম্পা বেগম, পিতা ইলিয়াস শেখ, গ্রাম: দেওয়ানা উত্তরপাড়া, থানা: দৌলতপুর, খুলনা)। ভিকটিম শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান ২০১৫ সালের ১০ জুন পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন।

জিডির সূত্র ধরে তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান এবং বাবা ইলিয়াস শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ২০১৩ সালে জনৈক রেজাউল করিম স্বপন (নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালে ভিকটিম শম্পা বেগম হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসাকালীন তার মেয়ে শম্পা বেগমের সঙ্গে রেজাউলের পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম এবং পরে ভিকটিম তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে সে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। এরপর শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে আসে। চট্টগ্রামে ভিকটিমের এক ফুফুর বাসায় কিছুদিন থাকে। এরপর ফয়েজ লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করে। পরে পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে বসবাস শুরু করে। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করে।

পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এসব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হলে রেজাউল করিম স্বপন শম্পাকে ২০১৫ সালের ২ মে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। আসামি লাশ গোপন করার উদ্দেশ্যে একটি ট্রাঙ্কে ভর্তি করে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেয় এবং সুচতুরভাবে ভিকটিমের বাবাকে জানায়, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরে ভিকটিম তার বাবার বাড়িতে না পৌঁছালে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেন। না পেয়ে ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন।

পিবিআই জানায়, ভিকটিমের বাবা পরবর্তীতে আসামি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গোপন তদন্তের ভিত্তিতে জানা যায়, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে তাকে তার বাহিনী বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়।

মামলাটি হওয়ার পরে দারুসসালাম থানা পুলিশ প্রায় তিন মাস তদন্ত করে। এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে সিআইডি প্রায় চার বছর তদন্ত করে লাশ শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে। আদালত মামলাটি লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর হওয়ায় রহস্য উদঘাটনের স্বার্থে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। পিবিআই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

এরপর পিবিআইয়ের একটি দল ভিকটিমের পরিচয় শনাক্ত ও মূল আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ভোরে কুমিল্লার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে।

ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি রেজাউল করিম স্বপন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!