খালি চেকে স্বাক্ষর, চট্টগ্রামের দম্পতি ছাত্রদল নেতার নিপুণ প্রতারণার শিকার

চট্টগ্রামের আকবরশাহ থানা এলাকার ফিরোজশাহ কলোনিতে থাকেন ইউসুফ ইকবাল-কামরুন্নাহার দম্পতি। তাদের পরিবারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি গোলাম নবী আপেলের (৪০)। সখ্যতার সুবাদে ইউসুফ-কামরুন্নাহারের ঘরে প্রায় আসা-যাওয়া ছিল আপেলের।

এর মধ্যে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে টাকার দরকার হয় কামরুন্নাহারের (৪৯)। এ বিষয়ে গোলাম নবী আপেলের সঙ্গে আলোচনা করলে আপেল তাকে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন। আর এজন্য স্বাক্ষরযুক্ত খালি চেক লাগবে বলে জানান। তার কথা অনুযায়ী কামরুন্নাহার ঢাকার কামরাঙ্গিরচরের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের রনি মার্কেট শাখার একটি খালি চেকে স্বাক্ষর করে দেন। এরপর স্বামীর চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কামরুন্নাহার। স্বামী সুস্থ হলে আপেলের কাছ থেকে চেক ফেরত চান কামরুন্নাহার। কিন্তু আপেল সেই চেকটি হারিয়ে গেছে বলে জানান।

এরপর একদিন কামরুন্নাহার জানতে পারেন তার নামে আদালতে ৫৭ লাখ টাকার একটি চেক প্রতারণা মামলা হয়েছে। মামলাটি করেন তারই ‘পারিবারিক বন্ধু’ গোলাম নবী আপেল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েন কামরুন্নাহার।

মামলার খোঁজ নিয়ে কামরুন্নাহার জানতে পারেন, সেই হারিয়ে যাওয়া চেক দিয়ে আপেল মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেন তাকে। অথচ চেক চুরি হওয়ার কথা শুনে মামলার দুই মাস আগে ঢাকার কামরাঙ্গিরচর থানায় ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কামরুন্নাহার। আর চুরি করা চেক দিয়ে ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা করেন আপেল।

মামলার পর টাকা আদায়ের জন্য গোলাম নবী আপেল বেশ কয়েকবার হামলা করেন কামরুন্নাহারের বাসায়। পরে কামরুন্নাহার তার বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে ২০২০ সালের এপ্রিলে মামলা করেন। আকবরশাহ থানা এই মামলায় তদন্ত রিপোর্ট দিলে নারাজি দেন কামরুন্নাহার। এরপর তদন্তভার ক্রাইম ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে (সিআইডি) দেন আদালত।

সিআইডি তদন্তের পর বের হয়ে আসে ‘থলের বিড়াল’। যেই গোলাম নবী আপেল চেক প্রতারণা মামলা করেছেন কামরুন্নাহারের বিরুদ্ধে, সেই আপেলই আসলে একজন বড় প্রতারক। তদন্তে একে একে বের হয়ে আসে তার প্রতারণার কুকীর্তি।

শুধু আকবরশাহের কামরুন্নাহার নন, হালিশহরের কোহিনূর বেগম এবং নোয়াখালীর নিকটাত্মীয় মামী কামরুন্নাহারের মতো অসংখ্য মানুষকে প্রতারণা ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা গোলাম নবী আপেল।

গোলাম নবী আপেল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অনন্তপুরের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে। বর্তমানে বন্দর থানার পোর্ট কলোনির এল ব্লকে ৩০৩/এ বাসায় থাকেন।

কামরুন্নাহারের বিরুদ্ধে আদালতে করা মামলায় গোলাম নবী আপেল উল্লেখ করেন, কামরুন্নাহারের স্বামী ইউসুফ ৭০ লাখ টাকায় জায়গা বিক্রি করার কথা বলে ৫৭ লাখ টাকা দেন আপেলকে। বাকি টাকা জায়গা রেজিস্ট্রির দিন দেওয়ার কথা। ৫৭ লাখ টাকা কামরুন্নাহারের ওই চেকের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে মামলার কোথাও জায়গা ক্রয় সংক্রান্ত বায়নানামার কথা উল্লেখ করা হয়নি।

গত ২৯ মার্চ আপেলের মামলায় হাজিরা দেন কামরুন্নাহার।

সিআইডি চট্টগ্রামের পরিদর্শক মুহাম্মাদ শরীফ গত ১৮ জানুয়ারি কামরুন্নাহারের দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। তাতে ওই নারীর স্বাক্ষরযুক্ত খালি চেকে (এসবি-১০৭৯২৩৪) গোলাম নবী নিজে টাকার অঙ্ক ও তারিখ বসিয়ে দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।

এছাড়া চেক প্রতারণা মামলা ছাড়াও হামলার অভিযোগ এনে কামরুন্নাহার, তার স্বামী ইউসুফ, ছেলে-দেবরসহ ৫ জনের নামে আরও একটি মামলা করেন আপেল। পরে পুলিশ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা না পেলে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

বাদির আইনজীবী মুহাম্মাদ হোসেন বলেন, গোলাম নবী আপেলের মতো এমন প্রতারক খুব কমই দেখেছি। সিআইডির এই তদন্ত প্রতিবেদন না পেলে এই মহিলার সাজাই হতো।

এর আগে ২০১২ সালের ৬ মার্চ নিকটাত্মীয় মামী নোয়াখালীর শ্রীপুরের কামরুন্নাহারকে (৪৪) প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন গোলাম নবী আপেল। ওইসময় আপেল তার বৃদ্ধ বাবা আবদুল জলিলকে দিয়ে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে আদালতে মামলা করেন কামরুন্নাহারের বিরুদ্ধে। পরে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।

এরপর ২০১৩ সালে ৯ জুন হালিশহরের ‘এল’ ব্লকের বাসিন্দা কোহিনূর বেগম (৪৪) নামের এক মহিলার সঙ্গে একই কায়দায় প্রতারণা করেন গোলাম নবী আপেল। কোহিনূরদের বাড়ির দ্বিতীয় তলায় চাইনিজ হোটেল ভাড়া নেওয়ার ভুয়া চুক্তি তৈরি করে ১৬ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে আদালতে মামলা করেন আপেল। এ মামলায় কোহিনূরের স্বামীসহ পরিবারের চার সদস্যকে আসামি করা হয়।

কোহিনূর বেগম বলেন, হুমকি ও সামাজিক হেয় প্রতিপন্ন ছাড়াও বখাটেদের নিয়ে মহড়া দিত আপেল। নানাভাবে হয়রানির একপর্যায়ে আমার স্বামী সামশুদ্দোহা বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে সমঝোতা করেন। ভবিষ্যতে এ বিষয়টি নিয়ে আর কোনো রকম সম্মানহানিকর কাজ না করার লিখিত অঙ্গীকার করে ২০১৪ সালে ৪ এপ্রিল ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে যান আপেল। টাকা নেওয়ার দুই দিন পর ২৬ এপ্রিল আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয় হালিশহর থানায় এবং ৬ মে আদালতে গিয়ে মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।

এছাড়া টেলিফোনে হুমকির দেওয়ায় বন্দর কলোনির বাসিন্দা সালাউদ্দিন খান (৬০) নামের এক ব্যক্তি গোলাম নবী আপেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন বন্দর থানায়।

চেক প্রতারণা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম নবী আপেল বলেন, ‘ফোনে আমাকে বিরক্ত করবেন না। এসব বিষয়ে পরে কথা বলবো।’ এরপরই তিনি ফোন কল কেটে দেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!